Thursday, February 13, 2025
29 C
Kolkata

সাম্রাজ্যবাদী ট্রাম্পের গাজা দখলের পরিকল্পনা:ফিলিস্তিনিদের গৃহহীন করার ষড়যন্ত্রকে মুখের উপর প্রত্যাখ্যান জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহর

মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘদিনের উত্তেজনা ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে বর্তমানে গাজা অঞ্চল মানবিক ও রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি গাজা স্ট্রিপের অধিকার লাভ করে পুনর্নির্মাণ করার এবং সেখানে থাকা প্রায় ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনি নাগরিককে অন্য আরব দেশে, যেমন জর্ডান ও মিশর, স্থানান্তর করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। এই প্রস্তাবটি আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ স্পষ্টভাবে ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে বলছেন যে, “গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে ফেলা নিয়ে আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ মতবাদ একমাত্র সমাধানের রাস্তা”।
প্রথমদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজা অঞ্চলের পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি সেখানে থাকা ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে অন্য দেশে স্থানান্তরের কথা বলেন। তাঁর মতে, গাজার অবক্ষয় ও ধ্বংসাবশেষ মুছে ফেলা এবং সেখান থেকে ২ মিলিয়ন নাগরিককে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হলে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। এমনকি তিনি একথাও বলেছেন, “আমরা গাজাকে আমাদের অধিকারভুক্ত করে নেব, এবং সেখানে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে”।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজার ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের জন্য জর্ডান এবং মিশরকে “পার্সেল” বা নির্দিষ্ট আঞ্চলিক জমি বরাদ্দ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি, তিনি জর্ডান ও মিশরের প্রতি অর্থায়ন বন্ধ রাখার হুমকি দিয়েছেন যদি তারা এই পরিকল্পনা মেনে না নেয়। তবে, এই হুমকি কিছু সময়ের জন্য সাময়িকভাবে প্রশমিত হয়েছে যখন রাজা আব্দুল্লাহ ২০০০ অসুস্থ শিশু ফিলিস্তিনি নেয়ার প্রস্তাব দেন।
রাজা আব্দুল্লাহ -এর অবস্থান
স্পষ্ট ও দৃঢ়। জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, “ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তর করা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।” তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লেখ করেন, “আমরা গাজা ও পশ্চিম তীরে থাকা ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে ফেলার বিরোধী।” এর পাশাপাশি, তিনি বলেন যে, “এই মতবাদই সমগ্র আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান”।
রাজা আব্দুল্লাহ ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে থাকলেও, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সহায়তার প্রস্তাব দেন। তিনি জানান যে, ২০০০ অসুস্থ ফিলিস্তিনি শিশুকে চিকিৎসার জন্য জর্ডানে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবটিকে ট্রাম্প প্রশংসা করেন এবং এটিকে “একটি সুন্দর উদ্যোগ” হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে, রাজা স্পষ্টভাবে পুনর্নির্মাণ ও মানবিক সহায়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দেন, যাতে গাজার ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নিজেদের মাটিতে ফিরে আসার অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।
রাজা আব্দুল্লাহ বারবার উল্লেখ করেছেন যে, জর্ডান ইতিমধ্যে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। অতীতে ১৯৪৮ সালে এবং পরবর্তীকালে বহু ফিলিস্তিনি জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছেন। তাই, অতিরিক্ত বড় পরিমাণে ফিলিস্তিনি স্থানান্তর করা জর্ডানের জাতীয় পরিচয় ও সামাজিক সাম্যবিচ্ছিন্নতার জন্য বিপজ্জনক হয়ে পরবে ।
জর্ডান ছাড়াও মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ ট্রাম্পের এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এগুলি সমগ্র আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ মতবাদকে প্রতিফলিত করে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশে রাখার দাবি ও “ফিলিস্তিনের অধিকার” বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে।
গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে “জাতিগত শুচিতা” বা “ইথনিক ক্লিন্সিং” হিসেবে সমালোচনা করেছেন। তারা এই প্রস্তাবকে তাদের নিজের ভিটেমাটি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত করে ফেলার চেষ্টা হিসেবে দেখেন, যা তাদের নাগরিক অধিকারে ও মৌলিক অধিকারের নীতিকে লঙ্ঘন করে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার গ্রুপ ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের এই ধরনের বলপূর্বক দেশছাড়া করে রাতারাতি শরণার্থী বানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং অন্তত নির্দয় পৈশাচিক, ঘৃণ্য, অসভ্য-ইতর মানষিকতার দৃষ্টান্ত বহন করবে।
ইসরায়েলের কিছু নেতারা ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেও, অন্যদিকে অনেক ইসরায়েলি ও পশ্চিমা দেশের নাগরিক এই প্রস্তাবের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তারা মনে করেন, এই পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলবে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত স্থানান্তরের ফলে গাজার মতো সংকটাপন্ন অঞ্চলে থাকা প্রায় ২ মিলিয়ন ফিলিস্তিনি নাগরিকের জীবনে অগণিত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের জবরদস্তি উদ্বাস্তুকরণ ও তার পরবর্তী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অমানবিক, জটিল এবং অসুবিধাজনক।এটি বাস্তবায়িত হলে মানবিকতার দুর্যোগের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
নতুন পরিবেশে বাস করতে গিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে, যা স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত করতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যের বিদ্যমান শান্তি প্রক্রিয়া ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ধারণাকে নড়াচড়ার মুখোমুখি করে তুলতে পারে।
জোরপূর্বক নাগরীক স্থানান্তর আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী নিষিদ্ধ, এবং এ ধরনের পদক্ষেপকে “ইথনিক ক্লিন্সিং” হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, রাজা আব্দুল্লাহ ও অন্যান্য আরব নেতারা মনে করেন যে, গাজার মানবিক সংকটের সমাধান নাগরীক স্থানান্তরের বদলে, গাজার পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে করতে হবে। তারা দাবি করেন:
১. দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান: ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
২. মানবিক সহায়তা ও পুনর্নির্মাণ: গাজার অবকাঠামো ও চিকিৎসা, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গাজা নিয়ে যে পরিকল্পনা প্রস্তাব করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক ও ওই অঞ্চলের নানান ধরণের প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। জর্ডানের রাজা আব্দুল্লাহ স্পষ্টভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে, ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজেদের দেশে থাকা ও মানবিক অধিকার রক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ মত অনুযায়ী, কোনভাবেই ফিলিস্তিনিদের বলপূর্বক অন্য দেশে স্থানান্তর করা উচিত নয়। ভবিষ্যতে গাজার মানবিক সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ও স্থায়ী শান্তির প্রক্রিয়া অগ্রাধিকার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

Hot this week

গরুকে “রাষ্ট্রমাতা” ঘোষণার দাবি ও তিব্র আন্দোলনের ঘোষণাউত্তরাখণ্ডের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বেঁধে দিলেন চরম সময়সীমা

উত্তরাখণ্ডের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী সম্প্রতি মোদি সরকারের প্রতি...

ইসরায়েল সরকারের উগ্র যুদ্ধাং দেহি মনোভাব: মানবতার উপর অবিচার

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের গাজা অবরুদ্ধ এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে চলমান...

রাজ্য হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলো মোহাম্মাদিয়া হাই মাদ্রাসা

হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে...

ছোট পোশাক পরে “পানশালায় নাচ” আইনত অপরাধ নয় ,রায় দিল দিল্লি আদালত

মহিলারা ছোট পোশাক পরে পানশালায় নাচলে তা ভারতীয় সংবিধানে...

Topics

ইসরায়েল সরকারের উগ্র যুদ্ধাং দেহি মনোভাব: মানবতার উপর অবিচার

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের গাজা অবরুদ্ধ এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে চলমান...

রাজ্য হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলো মোহাম্মাদিয়া হাই মাদ্রাসা

হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে...

ছোট পোশাক পরে “পানশালায় নাচ” আইনত অপরাধ নয় ,রায় দিল দিল্লি আদালত

মহিলারা ছোট পোশাক পরে পানশালায় নাচলে তা ভারতীয় সংবিধানে...

ইউপিএসসিতে দেশের মধ্যে প্রথম শিলিগুড়ি জয়দ্বীপ রায়বাংলার গৌরভ বাঙালির গর্ব

শিলিগুড়ির প্রতিভা জয়দীপ রায় UPSC কম্বাইন্ড জিও সায়েন্টিস্ট এক্সাম...

Related Articles

Popular Categories