Thursday, February 13, 2025
25 C
Kolkata

গরুকে “রাষ্ট্রমাতা” ঘোষণার দাবি ও তিব্র আন্দোলনের ঘোষণাউত্তরাখণ্ডের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বেঁধে দিলেন চরম সময়সীমা

উত্তরাখণ্ডের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী সম্প্রতি মোদি সরকারের প্রতি চরম সময়সীমা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, ‘গো’ বা গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ হিসেবে ঘোষণা করার। দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু সংগঠনগুলো এই দাবি তুলে আসা সত্ত্বেও সরকার পক্ষ থেকে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে এই দাবি ও তার সাথে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি প্রকাশ করেছেন তিনি।

স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বলেন, “আগামী ১৭ মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রকে সময় দিলাম। এর মধ্যে গোমাতাকে রাষ্ট্রমাতা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।”
এ সময়সীমার মধ্যে যদি সরকার এ দাবিতে কোনো উচ্চবাচ্য না দেন, তবে দিল্লির রামলীলা ময়দানে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত “গো প্রতিষ্ঠা নির্ণায়ক দিবস” অনুষ্ঠিত হবে। এই দিনের আয়োজনের পর থেকেই আন্দোলনের নতুন ধাপ আরম্ভ হবে এবং পরবর্তী রণকৌশল স্পষ্ট করা হবে।

গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করার দাবিটি বহুদিন ধরে হিন্দু সংগঠনের মূল স্লোগান হিসেবে প্রচলিত।

২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর, ধর্মীয় সংগঠন ‘গোপাল মণির নাম’ এর উদ্যোগে ‘গো-ক্রান্তি মঞ্চ’ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে চারটি শঙ্করাচার্য পীঠের সমর্থনে এই আন্দোলন জাগ্রত হয়।

ইতিমধ্যেই এই ইস্যুতে তিনটি গো সংসদ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে গরুর পবিত্রতা ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে তুলে ধরা হয়।

২০২৪ সালে গোবর্ধন থেকে দিল্লি পর্যন্ত একাধিক হিন্দু সংগঠনের সদস্যরা পদযাত্রা করে এই দাবিকে সামনে এনেছেন।

এই চলমান আন্দোলন ও প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গরুর পবিত্রতা ও সাংস্কৃতিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি প্রদান করা, যা কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক একটি বড় ইস্যু হিসেবে বিবেচিত।

গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করার দাবি কেবল ধর্মীয় চেতনায় নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবেও দেখা যাচ্ছে।

অনেক হিন্দু সংগঠন বিশ্বাস করে যে গরু তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের অঙ্গ, যার সঠিক স্বীকৃতি সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত।

এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার থেকে এই বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বা উচ্চবাচ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে আন্দোলনের নেতারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সরকারের তরফ থেকে পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলশ্রুতিতে আগামী ১৭ মার্চে উল্লেখিত সময়সীমার পর থেকে আন্দোলনের পরিধি আরও বিস্তৃত ও সংঘবদ্ধ হতে পারে, যা সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করতে পারে।

স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, যদি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সরকারের তরফ থেকে গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করার বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না আসে, তাহলে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজনকৃত গো প্রতিষ্ঠা নির্ণায়ক দিবস থেকে আন্দোলনের পরবর্তী রণকৌশল নির্ধারিত হবে।
এই পদক্ষেপে আন্দোলনকারীরা মনে করছেন যে, সরকার যদি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দাবিকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে জনমত সেই দাবি মঞ্চে তুলে ধরবে এবং বৃহত্তর হারে প্রতিবাদ ও জনসমর্থনের ঢেউ উঠবে হয়তো।

আজকের বিশ্বে যেখানে আমাদের দেশে অসংখ্য গুরুতর সমস্যা বিরাজ করছে—অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি—সেই সঙ্কটের মাঝে অনেকেই ফালতু ধর্মীয় জিগির এবং নানান অপ্রাসঙ্গিক দাবির মাধ্যমে নাগরিকদের মনোযোগ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই প্রেক্ষাপটে, গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করার মতো দাবিকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা যেভাবে জনসাধারণের দৃষ্টি ভ্রান্ত করছেন, তা বাস্তব সমস্যাগুলির মোকাবিলায় আমাদের অগ্রসর হতে দিচ্ছে না।

বর্তমান সমাজে যেসব গুরুতর সমস্যা বিরাজ করছে, তা একাধিক দিক থেকেই সমালোচনার দাবি রাখে।

বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবনতি, স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতালগুলির অবকাঠামো, শিক্ষার মান এবং চিকিৎসা সেবার অভাব দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক।

দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতার অভাব সমাজে গভীর অসন্তোষ ও অশান্তির সৃষ্টি করছে।

এই সমস্যাগুলো প্রতিটি নাগরিকের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে এবং এগুলোর সমাধানে সরকারের প্রতিশ্রুতি ও কার্যকর পদক্ষেপ অপরিহার্য, তবে তাৎক্ষণিক গুরুত্ব ও প্রাধান্য পাচ্ছে না।

বিজেপির মত কিছু রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় গোষ্ঠী যখন দেশের আসল সমস্যাগুলোতে না তাকিয়ে এমন দাবি তুলে নিচ্ছে যা কেবলই ধর্মীয় সিম্বলিজমে আবদ্ধ, তখন তা প্রকৃতপক্ষে নাগরিকদের মনোযোগ বিকৃত করে। উদাহরণস্বরূপ, গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করার দাবি:

এই দাবি এবং এর সাথে যুক্ত ধর্মীয় রীতিনীতি ও ঐতিহ্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তা দেশের সাংস্কৃতিক গৌরবের পরিচায়ক। বাস্তবে, এই রীতিনীতি নাগরিকদের সময় ও মনোযোগ অপচয়ের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের বৃহৎ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আসা উদ্দেশ্যহীন এবং মূল্যহীন অপপ্রচেষ্টা। যখন দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান নড়বড়ে, তখন এই ধরনের হাস্যকর দাবি জনগণ মেনে নেবে?

সরকারের তরফ থেকে যদি দেশের মৌলিক ও গুরুতর সমস্যাগুলোর সমাধানে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া হয়, তবে এমন বিষয়গুলোতে অতিরিক্ত জোর দেওয়া কেবল একটি বিভ্রান্তিকর নাটকেরই অংশ হবে। এতে করে সত্যিকার সমস্যা ও তাদের সমাধানের থেকে জনগণের দৃষ্টি হঠাৎ করে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুব সহজ হবে।

এমন অপ্রাসঙ্গিক ধর্মীয় জিগিরের মাধ্যমে দেশের আসল সমস্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার ফলাফল সুস্পষ্ট।

যখন নাগরিকরা দেখতে পান যে দেশের প্রধান সমস্যা ও দুর্দশা সমাধানের তুলনায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নাটকে সময় নষ্ট হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষের বীজ বপন হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ও নীতি প্রণয়নের পরিবর্তে এ ধরনের উদ্ভট দাবি ও রীতিনীতি সরকারের উন্নয়ন মূলক কাজের থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়।

ধর্মীয় বিষয়গুলিতে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে সমাজে বিভিন্নতা ও বিভাজনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক সমন্বয়, শান্তিও দেশের অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর।

যখন আমাদের দেশের জনগণ প্রতিদিন বেকারত্ব, দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সমস্যার মোকাবিলায় লড়াই করছে, তখন রাষ্ট্র ও সমাজের নেতাদের উচিত, তাঁদের সময় ও শক্তি এমন অপ্রাসঙ্গিক ধর্মীয় দাবিতে নষ্ট না করে দেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধানে মনোযোগ দেওয়া। গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ ঘোষণা করা কিংবা অন্যান্য মূল্যহীন দাবির মাধ্যমে নাগরিকদের মনোযোগ ভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা শুধু এক নাটকের মতো, যা আমাদের উন্নতি ও সমাজের বাস্তব সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে।

বাস্তব পরিবর্তনের জন্য আমাদের প্রত্যেকের উচিত, দেশের সত্যিকার সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো চিনে নিয়ে সেগুলো সমাধানে স্বচেষ্ট হওয়া। কেবলমাত্র তখনই আমরা একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যখন ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক নাটকে মনোযোগ হারিয়ে না, বরং সত্যিকার উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া হবে।

Hot this week

ইসরায়েল সরকারের উগ্র যুদ্ধাং দেহি মনোভাব: মানবতার উপর অবিচার

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের গাজা অবরুদ্ধ এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে চলমান...

রাজ্য হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলো মোহাম্মাদিয়া হাই মাদ্রাসা

হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে...

ছোট পোশাক পরে “পানশালায় নাচ” আইনত অপরাধ নয় ,রায় দিল দিল্লি আদালত

মহিলারা ছোট পোশাক পরে পানশালায় নাচলে তা ভারতীয় সংবিধানে...

Topics

ইসরায়েল সরকারের উগ্র যুদ্ধাং দেহি মনোভাব: মানবতার উপর অবিচার

বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের গাজা অবরুদ্ধ এবং ওয়েস্ট ব্যাংকে চলমান...

রাজ্য হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করলো মোহাম্মাদিয়া হাই মাদ্রাসা

হাই মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে...

ছোট পোশাক পরে “পানশালায় নাচ” আইনত অপরাধ নয় ,রায় দিল দিল্লি আদালত

মহিলারা ছোট পোশাক পরে পানশালায় নাচলে তা ভারতীয় সংবিধানে...

ইউপিএসসিতে দেশের মধ্যে প্রথম শিলিগুড়ি জয়দ্বীপ রায়বাংলার গৌরভ বাঙালির গর্ব

শিলিগুড়ির প্রতিভা জয়দীপ রায় UPSC কম্বাইন্ড জিও সায়েন্টিস্ট এক্সাম...

Related Articles

Popular Categories