
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দিলীপ ঘোষ এমন এক মুখ, যাঁকে ঘিরে বিতর্ক, কটাক্ষ এবং রাজনৈতিক উত্তাপ নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ঘিরে যে রাজনৈতিক জলঘোলা শুরু হয়েছে, তা যেন রাজ্য রাজনীতির এক নতুন মোড় নির্দেশ করছে।
সম্প্রতি দিলীপ ঘোষ একটি মন্তব্য করে রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। তিনি বলেন, “আমি সেই দল করি , যে দলের প্রধানমন্ত্রী (বাজপেয়ী) কালীঘাটে গিয়ে মমতা ব্যানার্জির মায়ের পা ছুয়ে প্রণাম করেছিলেন। মমতা তখন আমাদের সঙ্গে ছিল। আজ শত্রু হয়েছেন বলে আমি মানি না।” এই মন্তব্যে তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে একধরনের রাজনৈতিক নরমপন্থার সুর, যা অনেকের কাছে বিস্ময়ের। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যকার দীর্ঘদিনের রণনীতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে এই উক্তিকে অনেকে ‘ভিন্ন সুর’ বা ‘রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তন’ বলেই মনে করছেন।

এখানেই শেষ নয়। তারও আগে দিলীপ ঘোষ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করেন এবং সেখানে তাঁর উপস্থিতি ঘিরে নতুন করে জল্পনার সূত্রপাত হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, একজন বিজেপি নেতার হিন্দু ধর্মীয় তীর্থে যাওয়া অবশ্যই স্বাভাবিক বিষয় হলেও, কেন তা এতটা প্রচারসর্বস্ব হয়ে উঠল? অনেকে এটিকে তাঁর রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাবের প্রস্তুতি বলেও ব্যাখ্যা করছেন। আবার কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, দিলীপ ঘোষ বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্ব অনুভব করছেন, তাই রাজ্যে নিজের প্রভাব এবং ‘গ্রাউন্ড কানেকশন’ পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে ধর্মীয় আবেগ এবং বিরোধী দল সম্পর্কে নরম সুর অবলম্বন করছেন।

দিলীপ ঘোষের এই অবস্থান ঘিরে বিজেপির অন্দরেও দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই তাঁর মন্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে পাশ কাটাতে চাইলেও, রাজনৈতিক মহলে এটা স্পষ্ট যে, দিলীপ ঘোষ এখনো বঙ্গ রাজনীতিতে নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে চান এবং তা তিনি খুব সজ্ঞানভাবেই করে চলেছেন।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এই মন্তব্যকে ঘিরে নানা ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেছে। তাঁরা বলছেন, “বিজেপির নেতারাই বুঝে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজও মানুষের মনে আস্থা জাগান। তাই প্রাক্তন সম্পর্কের কথা স্মরণ করে ভবিষ্যতের রাস্তা খোঁজা হচ্ছে।”
বস্তুত, দিলীপ ঘোষ বরাবরই স্পষ্টভাষী নেতা হিসেবে পরিচিত, যাঁর মন্তব্যে অনেক সময় তাঁর দলের অস্বস্তি হয়েছে। কখনো মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে মন্তব্য, কখনো রাজ্যপাল বা সাংগঠনিক নেতৃত্বের সমালোচনা — সবই প্রমাণ করে তিনি দলীয় লাইন মেনে চলেন না। এটাই তাঁকে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছে, অন্যদিকে দলীয় নেতৃত্বের কাছে বিতর্কিতও করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দিলীপ ঘোষ কি রাজনৈতিক প্রান্তিকতা থেকে মূল স্রোতে ফিরতে চাইছেন? নাকি তিনি রাজ্যের রাজনীতিতে নিজের নতুন ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন?

রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি যখন চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন দিলীপ ঘোষের এই ‘সাংগঠনিক-বিচ্ছিন্ন স্বর’ আদৌ কতটা ফলপ্রসূ হবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে এতটুকু স্পষ্ট, দিলীপ ঘোষ ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এবং তিনি জানেন, কীভাবে নিজেকে রাজনৈতিক বিতর্কের মুখ্য চরিত্র করে তুলতে হয়।
এই অবস্থায় দল তাঁকে কীভাবে গ্রহণ করবে, এবং আগামী বিধানসভা নির্বাচন কিংবা সাংগঠনিক রদবদলে তাঁর কী ভূমিকা থাকবে, সেটিই এখন বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম কৌতূহলের বিষয়।