বর্ণিক: সাহিত্য পিপাসুর তৃষ্ণা  

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20210911-WA0049

সঞ্জয়কুমার দাসঃ উনিশ শতাব্দীতে ইউরোপ-আমেরিকায় লিটল-ম্যাগের সূচনা হলেও বাংলা সাহিত্যে লিটল-ম্যাগের পথচলা প্রমথ চৌধুরীর হাত ধরে। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে কবিগুরুর আশীর্বাণী নিয়ে ‘সবুজ পত্র’ যে অভিযানের সূচনা করে, কালের সরণি বেয়ে ‘বর্ণিক’ যেন প্রকৃতই তার যোগ্য উত্তরসূরি হওয়ার বাসনায় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে নিরন্তর। কিংবা ‘বঙ্গদর্শন’কে যদি প্রথম ধরি তাহলেও লিটল-ম্যাগের বয়স সার্ধশতবর্ষ (১৮৭২-২০২১)। তাই লিটল-ম্যাগ যে খুব লিটল নয়, তা ‘বর্ণিক’কে দেখলেও বোঝা যায়।

‘সময়’ জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক। পরস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে যেকোনো কর্ম সম্পাদনে। করোনা পরিস্থিতি অকল্পনীয় বহু অভ্যাসে পারদর্শী করে তুলেছে আমাদের। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে চলছে অফিস-আদালত। গুগল মিটে কিংবা জুমে দিব্যি চলছে স্কুল। পুস্তকাগারে ঝুলেছে তালা। একরকম বাধ্য হয়েই পাঠক বুঁদ হয়েছেন সফট বুকে। ঠিক এমতো পরিস্থিতিতেই এক ত্রিশীয় তরুণ ইউসুফ মোল্লা আবির্ভূত হলেন ‘বর্ণিক’ হাতে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে। করোনা তখন জাঁকিয়ে বসেছে, ‘বর্ণিক’ সম্পাদক মহাশয়ও জাঁকিয়ে বসতে চাইছেন সাহিত্যাঙ্গনে। যাকে বলে কোমর বেঁধে নামা। সাম্প্রতিককালে আর কোনো পত্রিকা এভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছছে কিনা তার দৃষ্টান্ত চোখে পড়েনি। ক্যানিং, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির পাঠকপ্রিয়তা বর্ণনাতীত। এই মুহূর্তে ভারতের বাইরে বাংলাদেশ, আমেরিকা, লন্ডন, নিউজিল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম, জেরুজালেম, দারুসসালামে রয়েছে পত্রিকার দপ্তর। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার সূচিপত্র থেকে নজর সরানো দায়। কে নেই সেখানে? বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির লেখকদের মধ্যে জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, মৃদুল দাশগুপ্ত, শ্রীজাত, সাতকর্ণী ঘোষ, মনোরঞ্জন ব্যাপারী, তৈমুর খান প্রমুখের উপস্থিতি পত্রিকাটিকে অন্য মাত্র দিয়েছে। দ্বিতীয় সংখ্যায় শঙ্খ ঘোষ, তৃতীয় সংখ্যায়, পবিত্র সরকার, হিন্দোল ভট্টাচার্য, সাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সৃষ্টি বর্ণিকের পৃষ্ঠাকে আলোকিত করেছে। ধীরে ধীরে নির্মলেন্দু গুণ, রাহুল পুরকায়স্থ, সেলিনা হোসেন, নলিনী বেরা, অমর মিত্র, ঋতম মুখোপাধ্যায়, তরুণ মুখোপাধ্যায়, সুমন গুণ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম ধারার কবি-সাহিত্যিকগণের সৃষ্টি ‘বর্ণিক’কে সমৃদ্ধির জোয়ারে ভাসিয়েছে। তবে শুধুই প্রতিষ্ঠিত নামজাদা কবি-সাহিত্যিকই নন, তাঁদের পাশাপাশি বহু অনামী লেখক ‘বর্ণিকে’র পৃষ্ঠায় স্থান করে নিয়েছেন। নিয়মনিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত সম্পাদক মহাশয় স্থাপন করলেন তাকে বিরলতম বললেও কম বলা। যা কোটিকে গোটিক।

 

৩১ অগস্ট ২০২১-এ প্রকাশিত ‘বর্ণিকে’র দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, শারদীয়া সংখ্যারূপে। গল্প, কবিতা, গুচ্ছ কবিতা, ইংরেজি অনুবাদ কবিতা, জাপানি অনুবাদ গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, রম্যরচনা ও বই সমালোচনা – এই ন’টি বিভাগে বিন্যস্ত ৮৮ পৃষ্ঠার সংখ্যাটির শুরুতেই আছে ‘অশ্বচরিত’, ‘ধ্রুবপুত্র’ খ্যাত কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের ‘অন্ন’ শিরোনামাঙ্কিত গল্প। কবিতা বিভাগের প্রথমেই বাংলাদেশের ‘একুশে পদক’ প্রাপ্ত কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘বৃদ্ধা’ কবিতা। খ্যাতনামা অনেকেরই কবিতা ‘বর্ণিকে’র শারদীয়া সংখ্যার সূচিপত্রকে আলোকিত করেছে। যাঁদের নাম না নিলেই নয়, রুদ্র গোস্বামী, শ্রীজাত, অনিন্দ্য রায়, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাজিমুর রহমান প্রমুখ তাঁদের মধ্যে স্মরণযোগ্য। কবি মণীন্দ্র রায়ের পুত্র অনিন্দ্য রায়ের কবিতাটি কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। অনেকটা গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর মতোই। তৈমুর খানের গুচ্ছ কবিতা বিভাগটি যেন পঞ্চবাণ। দ্বিতীয় ধারার কবিদের মধ্যে রোশনি ইসলামের হেমিস উৎসব, প্রবীর ভৌমিকের স্বাধীনতার ৭৫ বছর কিংবা হারাধন ভট্টাচার্যের তিতলির গল্প কবিতায় রূপ পেয়েছে। প্রবন্ধ বিভাগে পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়, নিরঞ্জন মন্ডল, তরুণ মুখোপাধ্যায়, ইউসুফ মোল্লা প্রমুখের দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আপন প্রতিভার সাযুজ্যে।

উর্দুভাষার প্রথম পত্রিকা ‘অদীব’ ও সম্পাদক মীর আকবর আলিকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটিতে এক ভিন্নস্বাদ এনে দিয়েছেন পুষ্পিত মুখোপাধ্যায়। ‘সোনারপুর’ নামকরণের ইতিবৃত্ত জানতে হলে পড়তেই হবে নিরঞ্জনবাবুর প্রবন্ধটি। শক্তি চাটুজ্জের কবিতায় পুরাণ অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠায় তরুণ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের মনন ঋদ্ধ প্রবন্ধটি ‘বর্ণিকে’র সম্পদ। ইউসুফবাবুর প্রবন্ধটিতে ধরা পড়েছে কবি নজরুলের শিশুমন। সবশেষে অজন্তা রায় আচার্যের পুস্তক সমালোচনা ‘বর্ণিকে’র শারদীয়া সংখ্যার বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করেছে। এ সংখ্যায় রয়েছেন অথচ যাঁদের নাম এ আলোচনায় ধরা গেল না, তাঁদের সৃষ্টিকর্মও নির্বাচনী মানদন্ডের বৈতরণি পেরিয়ে এসেছে। তাঁরাও রয়েছেন প্রমুখের আড়ালে। তাঁদের কথা বলা হবে, অন্যকোনো দিন, অন্য কোথাও, অন্যকোনো ভাবে। ভালোটুকুকে পাথেয় করেই হাজার বছর পথ হাঁটুক ‘বর্ণিক’। সাহিত্য পিপাসু মানুষের নিকট ‘বর্ণিক’ হয়ে উঠুক ‘সাহিত্যের ভগীরথ’। এই কামনা।

 

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর