
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে র্যাগিং-এর পুনরাবৃত্তি: কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে একের পর এক র্যাগিং-এর ঘটনায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তীব্র হয়েছে। সম্প্রতি কলেজ হোস্টেলে দ্বিতীয় বর্ষের এক জুনিয়র ছাত্রের উপরে তিনজন সিনিয়র ছাত্রের র্যাগিং-এর অভিযোগ উঠেছে। দুইজন চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া, একজন ইন্টার্ন। জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনে অভিযোগ দাখিলের পর কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাইস প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করলেও, তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ “ভুল বোঝাবুঝি” বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্মান্তিক র্যাগিং কাণ্ডের পরও কলেজ কর্তৃপক্ষের এমন নিষ্ক্রিয়তা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আস্থা ভেঙে দিচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে যে হোস্টেলে জুনিয়র শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া যে “এই ঘটনা ভুল বোঝাবুঝির ফল” তা র্যাগিং-এর মতো অপরাধকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার শামিল। র্যাগিং কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি সচেতন অপরাধ—এ কথা উল্লেখ করে শিক্ষার্থী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি কর্তৃপক্ষের ভূমিকাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কলেজেরই গত বছরের রেকর্ড বলছে, অর্থোপেডিক বিভাগের দুই সিনিয়রকে র্যাগিং-এর অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও র্যাগিং বন্ধ হয়নি, বরং পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এটিই প্রমাণ করে, শাস্তি নয়, প্রতিরোধমূলক কাঠামো গড়ে তুলতে কলেজ প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
অভিযোগের পর হোস্টেলে নজরদারি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু ক্যামেরা স্থাপন বা গেটের নিরাপত্তা বাড়ালেই কি র্যাগিং বন্ধ হবে? র্যাগিং একটি ক্যাম্পাস সংস্কৃতির বিষবৃক্ষ, যার শেকড় উপড়ে ফেলতে প্রয়োজন শূন্য সহনশীলতা ও কঠোর নীতির। অথচ কলেজ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপগুলি প্রতিকারের নামে কেবল প্রহসন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হোস্টেলে নিয়মিত নৈরাজ্য চলে, সিনিয়রদের আধিপত্য প্রতিরোধে কোনো সচেতনতামূলক কর্মশালা বা মনিটরিং সেল কার্যকর নেই।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মতো প্রেস্টিজিয়াস প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব শুধু চিকিৎসক তৈরি করা নয়, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করা। কিন্তু র্যাগিং রোধে বারবার ব্যর্থ হয়ে কর্তৃপক্ষ সেই দায়িত্বে খেলাপ করছে। প্রয়োজন :
১. শূন্য সহনশীলতা নীতি: 7 র্যাগিং-এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক স্থায়ী বহিষ্কার ও ফৌজদারি ব্যবস্থা।
২. মনিটরিং সেল: শিক্ষার্থীদের জন্য গোপন অভিযোগ বক্স, ২৪/৭ হেল্পলাইন ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা।
৩. সচেতনতা কার্যক্রম : সিনিয়র-জুনিয়র মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে ওয়ার্কশপ ও সেশন চালু করা।
৪. মহিলা হোস্টেল নিরাপত্তা : মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা নজরদারি ও কাউন্সেলিং ব্যবস্থা।
যাদবপুরের পর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা প্রমাণ করে, র্যাগিং প্রতিরোধে সরকারি নীতিমালা কাগজে-কলমেই সীমিত। শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হওয়ার পাঠ নিতে ক্যাম্পাসে আসে, কিন্তু র্যাগিং-এর বিষাক্ত পরিবেশ তাদের মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ করে তোলে। কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত, “ভুল বোঝাবুঝি”র অজুহাত না দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া এবং ক্যাম্পাসকে নিরাপদ করতে কার্যকর রোডম্যাপ প্রকাশ করা। নইলে এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে র্যাগিং-এর কালো অধ্যায়ই মুখ্য হয়ে থাকবে।