সময়ই আসল মূলধন, সময়ই আবার বিভীষণ

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

everyday-myths-time

~মোঃ নিয়াজ

তথ্য প্রযুক্তির শিখরছোঁয়া ডটকম যুগে মাউস হাতে কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে অবতীর্ণ হয়েছি। কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক হয়ে নিজের আখের গোছাতে গিয়ে আদতে আখের খাওয়াই হচ্ছে।

সময়ই আমাদের মূলধন। আবার সময়ই সবথেকে বড় শত্রু। সময়কে পাথেয় করে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। আবার সময় মেপে চলতে গিয়ে অনেক সময় পেন্ডুলামকেই বিভীষণ মনে হয়। ঘড়ির টিক টিক শব্দ যেন সর্বদা চোখ রাঙায়, শাসায়। আমরা অহরহ সময়ের দাসত্ব করে চলি। সময়ের কাছে আমরা অনুগত সৈনিক, নিবেদিত প্রাণ।

ইংরেজিতে ‘লাইফ’ মানে জীবন। লাইফ-এর মাঝেই রয়েছে ‘ইফ’ শব্দটা। যদি কখনও কিছু ঘটে যায় কী হবে? এই ‘যদি’র কথা ভেবেই আমরা সাবধান-সতর্ক ও সংযত হই। যদি-র জন্যই প্রস্তুতি নিতে হয়। জীবন তো মৃত্যুর অপেক্ষায় পসরা সাজানো। একদিন প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। যমের কোনো অরুচি নেই।

সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারলে একজন কপর্দকশূন্য মানুষও জিরো থেকে হিরো হতে পারে। আবার সময় অপচয় করলে বা সময়ের দাবি মেনে ঠিক সময়ে কাজ গুছিয়ে নিতে না পারলে মাইনাসে রান করতে হবে। তখন হিরো থেকে জিরো হওয়া অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী। সময় তার স্বতন্ত্রতায় ও স্বকীয়তায় লক্ষ্যভেদে নিজ কক্ষপথে আবহমান কাল থেকেই সক্রিয়। সময়ের পথে অন্তরায় সৃষ্টির ক্ষমতা বা সময়কে ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই।

টাকা দিয়ে সময় কেনা যায় না। ইচ্ছে করলে সময়কে এগিয়ে বা পিছিয়ে নেওয়া যায় না। জীবনের গোধূলি বেলায় পৌঁছে কেউ যদি একরত্তি বেলায় ফিরে যেতে চায়, সবাই বলবে বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে অথবা বিনাশ কালে বুদ্ধি নাশ হয়েছে। তিন কাল গিয়ে এক কালে আটকে এমন অ্যান্টিক্লক ভাবনা বাতুলতা মাত্র।

নিজের ইচ্ছেমত সময়ের অভিমুখ বা গতিপথ বদলানো যায় না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সময়ের সহজাত গতিপথ ধরে, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাহলেই কিস্তিমাত, নাহলে কুপোকাত। সময়ের গতিবিধির ওপর সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হবে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কিংবা সময়ের চোরাবালিতে পা রেখে ভিড়ের মাঝে একা হয়ে নিজেকে হারিয়ে হন্যে হয়ে বৃথা খোঁজাখুজি মূর্খের স্বর্গে অবগাহন করা নিতান্তই আহাম্মকের পরিচয়।

সময়ের মানদণ্ডেই কোনকিছুর মূল্যায়নে অসময়-দুঃসময় ইত্যাদি পদবাচ্য হয়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সঠিক পথ-পদ্ধতিতে পরিচালিত করতে পারলে ভবিষ্যত কণ্টকাকীর্ণ না হয়ে কুসুমাসতীর্ণ হয়। সময়ে সঠিক কাজ করতে না পারলে ঠকে ঠিকটা শিখতে অযথা ঠেকে পড়তে হয়।

শৈশব কৈশোরে খেলাধূলা, তারুণ্যে পড়াশোনা, যৌবনে কেরিয়ার গড়া, মাঝবয়সে সংসার যাপন, বার্ধক্যে অবসর — এগুলো মোটামুটি সবার জন্যই নির্ধারিত। এর বাইরে গিয়ে সময়কে ছাপিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালে আক্কেল সেলামি দিতে হয় বৈ কি।

সময়ের নিরিখে কোনও একটা বিষয় প্রাসঙ্গিকতা ও মান্যতা পায়। আবার সমসাময়িক অনেক বিষয় ডাস্টবিনে চলে যায়। অনালোকিত বিষয়কে সময়ই আলোকিত করে। সময়ের দর্পণেই অনালোচিত বিষয় চাঁদের হাটে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। তবে আলোচনায় আলো না থাকলে তা চোনায় পরিণত হয়। কালের করাল গ্রাসে শক-হুন-দল-পাঠান-মুঘল কত দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজত্ব, রাজবংশ ও রাজার উত্থান-পতন আজ নিথর ইতিহাস হয়ে গেছে। তাই সময়ে ভাবলে অসময়ে অভাব হয় না।

সময় নিজে অদৃশ্য হলেও সময়ের নিরিখে এই জগত সংসারে যা কিছু হয় বা ঘটে, তার সব অনুভূতিই আমাদের চর্মচক্ষে দৃশ্যমান হয়। কিছু আবার স্মৃতির সরণি বেয়ে সঞ্চিত হয় মানসপটে। মানুষকে শুধু “এলাম, দেখলাম, জয় করলাম” — এজন্যই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি। অনেক দায়িত্ব দিয়ে আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। সবথেকে গুরুদায়িত্ব হল ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে।

একজন মানুষ একাধিক গরহিত ও অমার্জনীয় অপরাধ করলে, দেশীয় আইন আদালত বড়জোর কয়েক বছর জেল, জরিমানা বা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। এখানে গুরুপাপেও সাজা মুকুব হয়ে যায়, আবার লঘুপাপেও গুরুদণ্ড হয়। ইহজগতে মানুষের পক্ষে যথোপযুক্ত সাজা বা কর্মফল প্রদান করা সম্ভবপর নয়। প্রকৃত কর্মফল অপেক্ষা করছে পরপারের জীবনে। পৃথিবীতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি বা দো দিন কা মুসাফির। মৃত্যু পরবর্তী জীবন হল অনন্তকাল। যার শুরু আছে, শেষ নেই।

তাই এই জীবনে যে নিঃশর্তে ও নিঃস্বার্থ ভাল কাজ করবে, সৎ পথে চলবে, ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নেবে, মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার জন্য নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবে না সেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সেই নৈতিকতা ও মানবতার দাবি যথাযথ পূরণ করে প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পেরেছে।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে দৈনিক ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড বা গড়ে ২৪ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ। যতই প্রভাবশালী বা বিত্তশালী হন না কেন, তার জন্যও একই সময়ে সূর্যোদয় ও সূর্যান্ত হয়। দিন-রাত সবার জন্যই সমান। কারও জন্য এক মাইক্রোসেকেন্ড কম বেশি হয় না। তাই যে বিষয়কে আমরা গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার দেব, সেই বিষয়ে আমরা পর্যাপ্ত সময় পাব। এটাই কালের অমোঘ নিয়ম।

প্রশ্ন হল, মৃত্যুর কাছ থেকে ধার নেওয়া কিছু সময়ের সমষ্টি এই জীবনকে আরাম-আয়েশ, মস্তি-মউজ, ভোগ-বিলাসিতায় কাটাব; নাকি দৈনন্দিন জীবনের জন্য বরাদ্দ ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে প্রতিদিন কিছুটা সময় ভালো কাজে লাগাব।

গতানুগতিক পথেই জীবন অতিবাহিত করলে অসময়ে হা-হুতাশ করে কপাল চাপড়ে, মাথা ঠুকে কোন লাভ নেই।

সবসময় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা আংশিকতা দোষে দুষ্ট হলেও আন্তরিকতা, সততা ও দক্ষতার সুষ্ঠু সমন্বয়ে ঠিকঠাক আবাদ করতে পারলে পতিত মানব জমিনে সোনা ফলতে বাধ্য। আমরা রোজকার কর্মব্যস্ততার জাঁতাকলে এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়েছি যে, আটপৌরে একঘেঁয়ে জীবনযুদ্ধের বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবার চেষ্টাকে বিলাসিতা মনে হচ্ছে।

চৌপোদিন শুধু অর্থ আর স্বার্থের কথা ভেবেই দিনাতিপাত করে চলেছি। সবক্ষেত্রে সেরার শিরোপা যেন আমার শিরেই সংক্রান্তি হয়ে থাকে, এই চিন্তায় অবিরাম মরিচিকার পিছনে দৌড়চ্ছি।

আমরা কেবল আলো ঝলমলে দিন চাই, রাতের অন্ধকারেও যে চাঁদের জোৎস্না হাসে তাকে আমাদের না-পসন্দ। আমরা কেবল জোয়ার দেখেই পুলকিত হই, ভাটার টানে বেলাভূমিতে যে কতকিছু ভেসে আসে তাতে আমাদের মন ভরে না। আমরা গোলাপ ভালবাসি, কিন্তু কাঁটার আঁচড় সইতে পারি না। আমরা চাই সব ব্যাপারেই যেন ভালগুলো আমাদের ক্ষেত্রে অকৃপণ হয়।

স্রোতের অনুকূলে সাঁতার দিতেই আমরা অভ্যস্ত, প্রতিকূলে ঢেউ ঠেলে এগোনোর কথা ভাবলে দমবন্ধ হয়ে আসে। এভাবে সময়ের গোলকধাঁধায় নিজেদের অজান্তেই নিজের অস্তিত্ব ও স্বতন্ত্র সত্তাকে পিষে চলেছি।

মাটি খুঁড়লে ইট, পাথর, লোহা অনেক পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সোনা বা হীরে পেতে হলে অনেক কসরত করতে হয়। ঝিনুকের ভিতর যে বন্দি থাকে, তার নাম মুক্ত। মাণিক পেতে হলে সাগর সেচতে হবে। আমরা কেবল শিখর ছুঁতে চাই, কিন্তু শিকড় মজবুত করি না। আকাশচুম্বি উচ্চতায় পৌঁছতে উদগ্রীব হয়ে লম্ফঝম্ফ করি, কিন্তু পায়ের তলার মাটিকে ভুলে যাই।

কুয়োর ব্যাঙ হয়ে জীবনভর আমিতেই ঘুরপাক খাই, আমি-র বহুবচন আমরা হতে পারি না। ছকে বাঁধা জীবনে নিছক ঘুঁটি সাজিয়ে চলি। টার্গেট একটাই, নীলে গেম দেওয়া। রোজকার যাপনচিত্রে চলে সাপ-লুডোর মহড়া। তবুও মুখে বলি সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কীসের ভয়?

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর