Saturday, April 19, 2025
32 C
Kolkata

কুম্ভ মেলায়,রাষ্ট্রের ধর্ম না ধর্মতে রাষ্ট্র ? 

হিন্দু ধর্মের সব থেকে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ তীর্থযাত্রা হল কুম্ভ মেলা। এই মেলার ইতিহাস মূলত হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত। কথিত আছে, অমৃত পাওয়ার জন্য অসুর ও দেবতাগনেরা একসঙ্গে সমুদ্র মন্থন করে। এবং সেই মন্থন থেকে উঠে আসা অমৃতর কয়েক ফোঁটা পৃথিবীর চারটি ধানে পড়ে। এই চারটি ধান অর্থাৎ, প্রয়াগরাজ (প্রয়াগ), হরিদ্বার, নাসিক এবং উজ্জয়িনীতে অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভ মেলা। এরপর আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে কুম্ভ মেলা।

ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে ২০২৫ সালের মহাকুম্ভ মেলা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ৬৫ থেকে ৬৬ কোটি দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে এই বছর। তাই জনতাই জনার্দন। যেখানে জনতা, সেখানেই ব্যবসায়ীদের আর্থিক লালসা চরিতার্থ হয়। আর যেখানে অর্থ, সেখানে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আনাগোনা। 

২৬ এর বিধানসভা নির্বাচন প্রায় দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল জোরকদমে শুরু করে দিয়েছে নিজ নিজ প্রস্তুতি। এহেন পরিস্থিতিতে এমন একটা ধর্মীয় সমাগম, ‘মেঘ না চাইতে জল’ হয়ে উঠেছিল প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কাছে। এমন টাই মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ধর্মীয় স্থানে হিন্দু সেবা, বা আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, ধর্মীয় স্থানে হিন্দু তোষণের মাধ্যমেই কি, ভোট ব্যালোটে হিন্দু ভোটকে সুনিশ্চিত করতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলি? উঠছে প্রশ্ন।

প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজে প্রথম বেঞ্চটা বরাদ্দ থাকে ক্লাসের ফার্স্ট বয়দের জন্য। যারা বছর শেষে রেজাল্ট বেরোনোর সময় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্নেহের পাত্র হয়ে যায়, সহপাঠীদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৫ কুম্ভ মেলায় দর্শনার্থী সেবায় মগ্ন বিজেপি খানিক এমনই ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এই দৌড়ে  বিজেপি, ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসা ইনোসেন্ট ফার্স্ট বয় হওয়ার চেষ্টা করলেও, শেষ রক্ষা আর হয়ে ওঠেনি। সাধারণ মানুষের কাছে বিঘ্নিত হয়েছে সেবক বিজেপির ভাবমূর্তি।

পরিকাঠামোগত সমস্যা:

মেলার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তৈরি না হওয়ায় ভক্তদের অসুবিধা হয়েছে। স্যানিটেশন, পানীয় জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা গেছে।

ভক্তদের নিরাপত্তার অভাব:

২০২৫ সালের কুম্ভ মেলায় বহু দর্শনার্থী পদোপৃষ্ট হয়ে আহত অথবা নিহত হয়েছে। পরবর্তীতে সরকারের বিরুদ্ধে, মৃতের সংখ্যা গোপন করার মতো ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে।

স্বাস্থ্যের অনিশ্চয়তা:

গত সপ্তাহে, কুম্ভ মেলা চলাকালীন কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ (সিপিসিবি) একটি রিপোর্ট জমা দেয়। যেখানে উল্লেখ করা হয় কুম্ভের জল দূষিত, এই জল নানযজ্ঞ নয়। এরপরই সরকারি তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

ব্যাহত যান চলাচল:

কেন্দ্রীয় সরকার দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন রাজ্য থেকে ট্রেন ও বাসের বন্দোবস্ত করেছিল। কুম্ভ মেলা শুরু হওয়ার পূর্বে, সরকারের নেওয়া এই উদ্যোগে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল গোদি মিডিয়া সহ নেটিজেনদের একাংশ। তবে এক্ষেত্রে মুখ পুড়লো সরকারের। প্রয়াগ এবং প্রয়াগ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়। ব্যবস্থার সামাল না দিতে পেরে দর্শনার্থীদের ফিরে যেতে অনুরোধ করা হয়। এছাড়াও দর্শনার্থীদের ভিড়ে ব্যাহত হয়েছে ট্রেন চলাচল।

২০২৪ এ লোকসভা নির্বাচনে ৪০০ পাড়ের স্বপ্ন প্রায় ধুলোয় মিশে গিয়েছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণ করা হয় অযোধ্যায়। বলাবাহুল্য, ২০২৪ লোকসভার ফলাফল বেরোনোর সময় রামলালা শরণাপন্ন হলেন না যোগীর ললাটে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র এনবিটিভি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “যদি সত্যিই আগামী নির্বাচনগুলিতে বিজেপির ভোট বাড়ে, সেক্ষেত্রে সেই ভোট বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হয়তো কুম্ভ মেলার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু এত আগে থেকে আমজনতা কোন রাজনৈতিক দলটিকে বেছে নেবে, তা নির্ধারণ করা শক্ত।” তিনি এও জানিয়েছেন, “সারা বিশ্বে রাজনীতি হলো নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের ক্ষমতা দখলের জায়গা। তারা প্রতিনিয়ত আরও বেশি ক্ষমতাবান ও পুঁজিবাদী হওয়ার চেষ্টা করে। ধর্মও অনেক ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদের পথ বেছেনেয়। সেই অর্থে দেখতে গেলে, আশির দশকের পর থেকে বিজেপি যখনই ভালো ফল করেছে, তার কারণ সংখ্যাগুরুর ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নিরিখে বলা যেতেই পারে, ধর্ম ভারতবর্ষের ভোটকে বহুবার প্রভাবিত করেছে। কিন্তু কুম্ভ আসন্ন ভোটগুলোতে কতটা প্রভাব বিস্তার করবে তা এত তাড়াতাড়ি অনুমান করা সম্ভব নয়। প্রতিযুক্তিতে গত লোকসভা নির্বাচনে অযোধ্যায় বিজেপির পরাজয়ের কথাও আসবে।”

ভারতের রাজনীতিকে মূলত দু ভাগে ভাগ করা যায়। একটি সংবিধান পূর্ববর্তী ভারতীয় রাজনীতি, অপরটি সংবিধান পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতি। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে দুই ক্ষেত্রেই, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য সাম্প্রদায়িক ধর্মের, ধর্মকে ব্যবহার করে এসেছে। ক্লাসের মধ্যে বিজেপি এই বিষয় ফাস্ট বয় হলেও, বিজেপিকে সমানভাবে টেক্কা দিতে মরিয়া, রাজনীতিতে বিজেপির আর এক সহপাঠী।

কুম্ভ মেলা চলাকালীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও  তৃণমূলের ব্লক সভাপতি দিলীপ মাঝিকে  কুম্ভ স্নান করতে দেখা যায়। তাদের ধর্ম ক্ষেত্রে, ভক্তি জ্ঞাপনে কারুর কোন সমস্যা না থাকলেও, ভুরু কোচকাচ্ছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।

হিন্দু ধর্ম মতে কথিত আছে, গঙ্গাস্নানে পাপোঅক্ষয় হয়। রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গঙ্গাস্নানের পর, যোগী সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে বেলাগাম প্রশংসা কি কোন রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে?  প্রশ্ন নানান মহলে। রচনা-কাঞ্চনের এই আধ্যাত্মিক সফর কি সত্যিই ধর্মীয় জাগরণ, নাকি ভোটের গণিত মেলানো? প্রশ্ন রয়ে যায়। তবে একথা ঠিক, বাংলার রাজনীতিতে এখন”রচনা-কাঞ্চন” জুটির ভক্তিই বেশি ট্রেন্ড করছে!  

“ধর্মনিরপেক্ষতা”র জয়গান গেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস যুগ যুগ ধরে বিজেপির “হিন্দুত্ববাদ”-কে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দলের দুই নেতা রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কাঞ্চন মল্লিকের “হিন্দু অ্যাওয়াকেনিং” দেখে প্রশ্ন উঠছে—”সেকুলারিজম” কি শুধু মুসলিম ভোটারদের জন্য রিজার্ভ, নাকি হিন্দু ভোটের সামনে নীতি বদলানো? 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এখন কুম্ভ স্নান মানে—জলে ডুব দেওয়া নয়, ভোটারদের মগজে নাম লেখানো। আগে সাধু-সন্ন্যাসীরা আসতেন, এখন নেতারা এসে ‘হরিহর আত্মা’ সাজছেন!”

তৃণমূল নেত্রী ও সাবেক অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কাঞ্চন মল্লিক সম্প্রতি হিন্দুত্বের নতুন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তাদের এই “আধ্যাত্মিক উথালপাথাল” দেখে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন—এটা কি ধর্মের প্রতি প্রেম, নাকি ভোটের ঘাটতি মেটানোর মহাযজ্ঞ?

সাম্প্রদায়িক ধর্ম, ধর্মীয় রাজনীতি, এই দুটো শব্দে ধর্মটা কমন ফ্যাক্টর। তাই আরো একবার স্মরণ করা যাক ভারতীয় সংবিধানে রচিত সেই বাণীটি।

আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, রূপে গড়িয়া তুলিতে, এবং উহার সকল নাগরিক যাহাতে:

সামাজিক, আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক ন্যায়বিচার;

চিন্তার, অভিব্যক্তির, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা;

প্রতিষ্ঠা ও সুযোগের সমতা

নিশ্চিতভাবে লাভ করেন;

এবং তাঁহাদের সকলের মধ্যে

ব্যক্তি-মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির আশ্বাসক ভ্রাতৃভাব বর্ধিত হয়;

তজ্জন্য সত্যনিষ্ঠার সহিত সংকল্প করিয়া আমাদের সংবিধান সভায় অদ্য, ২৬শে নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করিতেছি, বিধিবদ্ধ করিতেছি এবং আমাদিগকে অর্পণ করিতেছি।

Hot this week

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

চাকরিহারা শিক্ষকদের লড়াইকে সংহতি না জানিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তি “আমায় রাজনীতিতে জড়াবেন না”

কলকাতা: রাজ্যে চাকরি বাতিলের ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সুপ্রিম...

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে চলন্ত বাসে আগুন! জানালা ভেঙে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর ঘটে গেল এক...

শোয়েবকে খুন করে, তার ফিরে আসার দোয়া করলেন মৌলানাযা দেখে রীতিমতো শিউরে উঠে মহারাষ্ট্রের পুলিশ।

হাড়হিম হয়ে যাওয়া এক নারকীয় হত্যার সাক্ষী থাকলো মহারাষ্ট্র।...

Topics

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে চলন্ত বাসে আগুন! জানালা ভেঙে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর ঘটে গেল এক...

গাজায় আবারও রক্তঝরা দিন, খান ইউনুসে একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় খান ইউনুস এলাকায় ইসরায়েলের একটি বিমান হামলায় একই...

পার্কস্ট্রিটে ফের আগুন! কুইন্স ম্যানসনের বহুতলে আতঙ্ক, কালো ধোঁয়ায় ঢাকল মিষ্টির দোকান

পার্কস্ট্রিটে ফের আগুন! কুইন্স ম্যানসনের বহুতলে আতঙ্ক, কালো ধোঁয়ায়...

Related Articles

Popular Categories