
বাংলাদেশ এক সময় বহুমুখী সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশ ও উৎসব উদযাপনের মেলবন্ধন হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে দিনে উগ্র মৌলবাদী শক্তির আক্রমণে তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতি অত্যাচার, হুমকি ও সহিংসতা বেড়েছে, যা শুধুমাত্র একটি এলাকা বা সম্প্রদায়ের বিষয় নয়, বরং দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকেও অন্ধকার পর্দায় ঢেকে দিচ্ছে।
গত নভেম্বর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতন ও ধর্মীয় উদযাপনের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধির খবর মুখে এসেছে। দুর্গাপুজো ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় মন্দিরে ভাঙচুর, লালন স্মরণোৎসব ও বসন্ত উৎসব বন্ধ করার ঘটনাগুলো দেশব্যাপী উদ্বেগের লাল সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনার পেছনে রয়েছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক নির্বাসন যা দেশের ঐতিহ্যবাহী পরিচয়কে সংকুচিত করছে।
১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে, ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল বিক্রির অপরাধে এক ফুলের দোকানে হঠাৎ সহিংসতা শুরু হয়। দোকানদার আলমের মতে, আগের দিন থেকেই তাকে নিষেধ করা হলেও, দুপুরের প্রায় কিছু ইসলামিক উগ্রপন্থী দলের লোক দোকানে আক্রমণ চালিয়ে ফুলগুলো রাস্তায় ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় প্রতিবাদকারীরা স্পষ্ট করে চিৎকার করে বলে, “ভালোবাসা দিবসে কেন ফুল বিক্রি? এখানে চলবে না!”—এক প্রকার সহিংস, বিদ্রূপাত্মক স্লোগান ওঠে।
ঠিক পরের দিনেই, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং সহিংসতার পুনরাবৃত্তি এড়াতে, গোপালপুর উপজেলার ঘুড়ি উৎসব বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বহু বছরের ঐতিহ্যে ডুবে থাকা এই উৎসব এখন একটি নিরুৎসাহিত আয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তরুণ ও শিক্ষার্থীরা অংশ নিত, কিন্তু এখন তাদের মুখেও ভয়ের ছায়া স্পষ্ট।
দেশব্যাপী এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, একদিকে স্বাধীনতা ও বহুসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার স্বপ্ন থাকলেও, অপরদিকে কিছু উগ্র ইসলামিক মৌলবাদী দল নিজেদের জোরালো মতবাদ আর সহিংসতার মাধ্যমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রবেশ করতে সচেষ্ট। তাদের কর্মকান্ড শুধু এক নির্দিষ্ট এলাকা বা ঘটনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক বিন্যাসে একটি জটিল ও বিপজ্জনক প্রভাব বিস্তার করছে।
অবিশ্বাস্য হলেও, এ সকল উগ্র কর্মকাণ্ডের সময়ে দেশের বর্তমান প্রশাসন—যাকে কিছু বিশেষ পর্যবেক্ষক “নন ইলেকটেড ইউনূস প্রশাসন” হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন—তার নীরব, পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
আক্রমণের পরেও যথাযথ প্রতিকার ও তদন্তে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে স্পষ্ট দুর্বলতা প্রদর্শন করেছে, যা ইঙ্গিত করে যে, এই সহিংস কর্মকাণ্ডকে চুপচাপ অনুমোদন বা নীরবে সমর্থন করা হচ্ছে।
নিরাপত্তার অস্বচ্ছতার নামে বহু সাংস্কৃতিক উৎসব ও অনুষ্ঠানের বাতিলকরণ—যা শুধু উগ্রবাদী দলের প্রচারণাকে উৎসাহিত করছে—তাও প্রশাসনের নীরব সমর্থনের পরিচয় বহন করে।
এই নীরব সমর্থন শুধুমাত্র সরকারের দুর্বল প্রশাসনিক নীতিরই পরিচায়ক নয়, বরং এক প্রকার মতবাদ ও আদর্শগত অবক্ষয়কে সজীব করে তোলে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে, উগ্র ইসলামিক মৌলবাদী শক্তি এখন শুধু সহিংসতার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে না, বরং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতি আক্রমণও চালিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশটির ঐতিহ্যবাহী উৎসব, উদযাপন ও স্বাধীন চিন্তাধারা এক ধরণের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
নীরব, পরোক্ষ প্রশাসনিক সমর্থন এই সহিংসতা ও বিদ্বেষকে আরও বলবৎ করে তুলছে। এখন সময় এসেছে সেদেশের জনসাধারণের সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠনের জোরালো প্রতিবাদের, এবং একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক নীতির দাবি করার। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, একদিকে স্বাধীন চিন্তাধারা ও বহুসাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষায়, অপরদিকে উগ্রপন্থী জাগরণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর।
এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য, ঘটনা ও বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান উগ্র মৌলবাদ ও প্রশাসনিক নীরব সমর্থনের বিপজ্জনক প্রভাবকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।