বাংলাদেশে বহু শতাব্দী ধরে মানবতা, সাম্য ও বন্ধুত্বের বার্তা প্রচার করে আসা লালন ফকিরের জীবনদর্শন আজকের সাংস্কৃতিক জগতে একটি অমূল্য ঐতিহ্য। তাঁর “কেউ মালা কেউ তসবিহ গলে” শ্লোকের মতো বার্তা মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্মান ও সাদৃশ্যের পক্ষে ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী সংগঠন যেমন হেফাজতে ইসলাম ও কওমি ওলামা পরিষদের হস্তক্ষেপে এই মানবতাবাদী আদর্শের মুখে শুষ্কতা আসতে দেখা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে, মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে মৌলবাদী ভাবধারা ও কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করার প্রচেষ্টা সমালোচনার তীক্ষ্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লালন ফকির শুধুমাত্র একজন কাব্যকার বা গায়ক ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানবতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। তাঁর গান ও বাণী ছিল সকল ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্যের বার্তা। এই আদর্শের বিপরীতে, মৌলবাদী মতবাদে ধর্মীয় শিরক-ইতিহাসিক বৈষম্য ও জঘন্যতার প্রচার দেখা যায়, যা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ন করছে।
১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে মধুপুর উপজেলার বাসস্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকা লালন স্মরণোৎসব, হেফাজতে ইসলাম ও কওমি ওলামা পরিষদের হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক সবুজ মিয়া জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানটি প্রশাসনিক অনুমতি না নিয়ে আয়োজিত হওয়ায় হঠাৎ করে ধর্মীয় নেতারা বাধা দেন – যার মধ্যে লালনের “ভ্রান্ত মতাদর্শ” নিয়ে আপত্তি ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ঘটনার ফলে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটে নি, বরং দেশের বহুমুখী ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকেও আঘাত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে, মৌলবাদী সংগঠনগুলো বিভিন্নভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করে আসছে। সরকারের নীতি ও ব্যবস্থাপনায় মৌলবাদী মতবাদকে প্রচার বা অন্তত তাদের বিরোধিতা করতে ব্যর্থ হওয়ায়, জাতির সাংস্কৃতিক ও মানবতাবাদী মর্মবোধ ক্ষীণ হচ্ছে।
মৌলবাদী সংগঠনগুলো এমনকি হিন্দু বাড়ি, মন্দিরে হামলা, সম্পত্তি দখল ও লুঠপাটের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছে, যা দেশের সমাজে দ্বন্দ্ব ও বৈষম্যের বীজ বপন করেছে।
তদুপরি, লালন স্মরণোৎসবের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই মৌলবাদীদের প্রতিরোধ করার পরিবর্তে, তাদের বাধা প্রদান করে সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এই অবস্থাকে সমালোচনার কণ্ঠে তসলিমা নাসরিনও ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন – “সরকার কি হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবে?” – যা প্রশ্ন তোলার মতো অবস্থা নির্দেশ করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে এক নতুন আশা জাগ্রত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে মৌলবাদী সংগঠনগুলো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে সমাজের বহুমুখী আদর্শকে ক্ষুণ্ন করছে।
মৌলবাদী মতবাদ প্রচারকারী এই সংগঠনগুলো, যাদের দ্বারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিবর্তন ও বন্ধের ঘটনা ঘটেছে, তাদের কর্মকাণ্ডের সাথে সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের অসমতা স্পষ্ট হয়।
সরকারের তরফ থেকে মৌলবাদীদের বিরোধিতা করার বদলে, একদিকে মৌলবাদী কর্মকাণ্ডকে প্রশংসা বা নীরব সমর্থন করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা একটি দ্বন্দ্বমূলক সমাজ গঠনে মারাত্মক বাঁধা।
এই পরিস্থিতিতে, সরকারের উচিত ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রক্ষার্থে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে লালন ফকিরের মানবতাবাদী আদর্শ ও মুক্তমনা চিন্তাধারা রক্ষা পায়। তবে, সরকারের নীতিগত অস্পষ্টতা ও মৌলবাদী সংগঠনের প্রভাব বিস্তারের ফলে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চিত্র ক্রমেই ধ্বংসের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রতিবেদনকারীরা (রিপোর্টার) ও সমাজসেবী, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা এই ঘটনাকে গভীরভাবে সমালোচনা করেছেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মৌলবাদী হস্তক্ষেপের ফলে দেশের যুব সমাজ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা একটি উদার ও বহুমুখী সমাজ গঠনে বাঁধা সৃষ্টির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলবাদী নীতির প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুন্ন হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাধা প্রদান করবে।
বিরোধী ও সমালোচকদের দাবি, এই মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না নিলে, সমাজে দ্বন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
তসলিমা নাসরিনের মতামত ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনার মধ্যে স্পষ্ট দেখা যায় যে, মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে সরিয়ে না ফেলে, দেশের সাংস্কৃতিক ও মানবতাবাদী আদর্শকে পুনর্জাগরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা লালন ফকিরের মানবতাবাদী ও মুক্তমনা আদর্শের মূলে রচিত, তা মৌলবাদী সংগঠনগুলো ও সরকারের নীতিগত দুর্বলতার কারণে আজ এক বিরাট সংকটের মুখোমুখি। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে, যেখানে দেশের উন্নয়ন ও শান্তি পুনরুদ্ধারের আশায় নতুন সূচনার কথা ছিল, মৌলবাদী ভাবধারা ও কর্মকাণ্ডের প্রচারে যে অপচেষ্টা দেখানো হয়েছে, তা দেশের ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
এক্ষেত্রে, সরকারের উচিত ছিল মৌলবাদীদের বিরোধিতা করে একটি উদার, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমবায়ী সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা – যাতে লালন ফকিরের ঐ ঐতিহ্য রক্ষা পায় এবং সমাজে মানবতা, সমতা ও শান্তির বার্তা বয়ে যায়।