পশ্চিমবঙ্গের বাজেট ২০২৫-২৬-এ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী, বিভিন্ন শিল্প, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বিরোধী দল ও বামপন্থী সমালোচকরা এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন – বাস্তবে কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটাতে কি বাজেট যথেষ্ট, নাকি এগুলি কেবল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে রয়ে যাবে?
১. কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মূল উদ্যোগ
(ক) শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান
সরকার ঘোষণা করেছে যে, শিল্পকেন্দ্র এবং নতুন প্রযুক্তি-ভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নিউ টাউনের সিলিকন ভ্যালিতে প্রায় ৭৫,০০০ নতুন কর্মসংস্থানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং কিছু খাতে এমনকি লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য রাখে।
(খ) পরিকাঠামো নির্মাণ ও গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প
বাজেটে গ্রামোন্নয়ন, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরে ব্যাপক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারে। পরিকাঠামো নির্মাণ মূলক প্রকল্প যেমন – রাস্তা, সেতু, নয়া ‘নদী বন্ধন’ প্রকল্প ও ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রভৃতি, এগুলোর মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি, ‘কর্মশ্রী প্রকল্প’ এর মতো স্বল্পমেয়াদী কর্মসংস্থানের উদ্যোগের মাধ্যমে শেসতরুণ ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীকে লাঘব দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
(গ) সেক্টরভিত্তিক বিনিয়োগ ও উৎসাহ
কৃষি, কারিগরি শিক্ষা, ও ক্ষুদ্র ও ছোটো ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করার পরিকল্পনাও বাজেটে অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি ও কৃষিজ বিপণন বিভাগের বরাদ্দ বৃদ্ধি, প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন, এবং শিল্প-ব্যবসায়িক খাতে নতুন ইনসেনটিভ স্কিম প্রবর্তনের মাধ্যমে এই খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
২. কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাজেটের কার্যকরী প্রভাব
(ক) প্রত্যাশিত সুবিধা
সরকারের মতে, উল্লিখিত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে প্রযুক্তি, শিল্প ও অবকাঠামো খাতে চাকরির সৃষ্টির মাধ্যমে state’s GDP বৃদ্ধি পাবে এবং যুবসমাজের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ লাভবান হবেন। এর পাশাপাশি, গ্রামীণ উন্নয়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশে সার্বিক কর্মসংস্থানের হার বাড়াতে সহায়ক হবে।
(খ) চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
তবে বিরোধী দলের মতে, এই বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি অনেকাংশে নির্বাচনী উদ্দেশ্যে প্রদত্ত মুখশব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাস্তবায়নের অভাব:
যদিও বিভিন্ন খাতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসংস্থান লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে, তা কার্যকরীভাবে রূপান্তরিত করার জন্য বিস্তারিত রোডম্যাপ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।
আভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সমস্যা:
শিল্প, কারিগরি শিক্ষা ও পরিকাঠামো খাতে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিবর্তন ও কাঠামোগত সমস্যাগুলির সমাধান না হলে, শুধুমাত্র প্রকল্প ঘোষণার মাধ্যমে তা অর্জন করা কঠিন হবে।
আঞ্চলিক বৈষম্য:
শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ বিভাজিত রয়েছে। যদিও গ্রামীণ উন্নয়নে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা শহুরে শিল্প ও প্রযুক্তিগত খাতে চাকরি সৃষ্টির ক্ষেত্রে একে অপরকে পরিপূরক করে তুলতে ব্যর্থ হতে পারে।
৩. বিকল্প নীতিমালা ও সুপারিশ
(ক) বাস্তবায়ন পরিকল্পনার স্পষ্টতা
সরকারকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পরিণত করার জন্য বিস্তারিত রোডম্যাপ ও বাস্তবায়ন নীতি তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ, সময়সীমা ও ফলাফল পরিমাপের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি।
(খ) প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন
প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের জন্য শুধুমাত্র চাকরি সৃষ্টি নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ও কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য, আধুনিক ল্যাব, ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা উচিত।
(গ) আঞ্চলিক উন্নয়নের সমন্বয়
শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও স্থানীয় উদ্যোগকে সমর্থন করতে বিশেষ বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজন। গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে, স্থানীয় শিল্প, কৃষি ও কারিগরি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
(ঘ) সরকারী ও বেসরকারী অংশীদারিত্ব
কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করা উচিত। এসএমই ও কর্পোরেট খাতে ইনসেনটিভ স্কিম চালু করে, প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে।
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গ বাজেট ২০২৫-২৬-এ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা খাতে প্রস্তাবিত উদ্যোগ ও বরাদ্দ রয়েছে। সরকার দাবি করছে, শিল্প, প্রযুক্তি, অবকাঠামো ও গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে বিরোধী দল ও বামপন্থী সমালোচকদের মতে, এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কাঠামোগত পরিবর্তনের অভাব রয়েছে।
একটি সফল কর্মসংস্থান ভিত্তিক বাজেটের জন্য সরকারের উচিত:
বিস্তারিত বাস্তবায়ন রোডম্যাপ তৈরি করা,
প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের দিকে যথাযথ বিনিয়োগ করা,
আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা,
সরকারি ও বেসরকারী খাতে অংশীদারিত্ব বাড়ানো।
এভাবে, পশ্চিমবঙ্গের বাজেট যদি কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে তা রাজ্যের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে যুবসমাজ ও জনগণের জীবিকার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।