বাজেট ও সংখ্যালঘু বঞ্চনার ইতিবৃত্ত

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

image

~মুদ্দাসসির নিয়াজ


বাজেট হল আগামী এক বছরের জন্য সরকারি আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য খতিয়ান। প্রতি বছর বাজেটে নতুন কিছু পরিকল্পনা ও প্রকল্পের ঘোষণা করা হয় এবং একইসঙ্গে সেইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে কোথা থেকে অর্থ আসবে, সেই দিশারও উল্লেখ থাকে। এটাই হল বাজেটের মোদ্দা কথা। যদিও বাস্তবে দেখা যায় বাজেট কস্মিনকালেও ডান-বামে মেলে না।
কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার ৫০ বছরের বেশি রাজত্ব করলেও সংখ্যালঘু উন্নয়নে সর্বপ্রথম পৃথকভাবে বাজেট বরাদ্দ চালু করেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর কোয়ালিশন সরকার। ১৯৮৯ সালে ভিপি সিংয়ের আমলেই প্রথমবার সংখ্যালঘু উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। তার সাড়ে তিন দশক পর এবার এই খাতে বরাদ্দ হল ৩০৯৭ কোটি, অর্থাৎ ৩৪ বছর পর বরাদ্দ বৃদ্ধি মাত্র ৬ গুণ। ২০১৩-১৪ সালে মনমোহন সিং-এর ইউপিও সরকারের শেষ বাজেট ছিল ৭ গুণ বেশি। গতবছর সংখ্যালঘু উন্নয়নে মোদি সরকারের বরাদ্দ ছিল ৫০২০ কোটি। এবার তা ৪০ শতাংশ বা ১১২৩ কোটি টাকা কমিয়ে করা হল ৩০৯৭ কোটি টাকা। যা দেশের মোট বাজেটের ০.১ শতাংশেরও কম। অথচ এ দেশে সংখ্যালঘু বলতে মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন, বৌদ্ধ সব মিলিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বা মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। উল্লেখ্য, গতবছর ৫০২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও খরচ করা হয় মাত্র ২৬১২ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ অর্ধেকের মতো।
কেন্দ্র সরকার সংখ্যালঘু খাতে যেখানে মাত্র ৩০৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এই খাতে বরাদ্দ অনেক বেশি। এর থেকে বিস্ময়কর আর কী হতে পারে? অথচ ইদানিং দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার ছলে বলে কৌশলে মুসলিম ভোট জাফরান শিবিরের ঝুলিতে টানতে নানারকম কথাবার্তা বলছেন, যা সংঘ পরিবারের ঐতিহ্য ও পরম্পরার পরিপন্থী হলেও শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে তৃতীয় দফায় ক্ষমতা ধরে রাখতে মোদিজী এটা করছেন। যদিও কেন্দ্র সরকারের কথা এবং কাজে আসমান-জমিন ফারাক। কেবলমাত্র ক্ষমতার মোহে সেই ফারাক ঘোচাতে অতি সম্প্রতি আরএসএস-এর সদর দফতর নাগপুরে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে সংঘী নেতৃত্ব। অথচ কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে অষ্টরম্ভা।
সব মিলিয়ে বলা যায়, গত ৮ বছরের তুলনায় এবার সংখ্যালঘু খাতে বিরাট কোপ দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। পেশাদার ও কারিগরি কোর্সের জন্য মেরিট বৃত্তি ৮৭ শতাংশ কমিয়ে করা হয়েছে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা। গতবছর যা ছিল ৩৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার এতে বরাদ্দ কমিয়ে ৯ ভাগের ১ ভাগ করা হল। মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু শিক্ষা খাতে গতবছর ছিল ১৬০ কোটি টাকা। যদিও তা খরচ করা হয় মাত্র ৩০ কোটি টাকা, বা ৫ ভাগের ১ ভাগও নয়। এবার তা ৯৩ শতাংশ কমিয়ে করা হল মাত্র ১০ কোটি টাকা। দেশের ২৮টা রাজ্য এবং ৯টা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্য সাকুল্যে ১০ কোটি মানে প্রত্যেক রাজ্য পাবে মাত্র ২৭ লক্ষ ২ হাজার টাকা করে। এই নামমাত্র টাকায় প্রতিটা রাজ্য তাদের মুসলিম নাগরিকদের উন্নয়ন ঘটাবে, এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে! এই অংক শুনলে গাধাও হাসবে। গতবার সংখ্যালঘুদের ফ্রি কোচিং বাবদ বরাদ্দ ছিল ৮০ কোটি টাকা, এবার তা কমে হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। এভাবে সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে সব ক্ষেত্রেই এত বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে, যা বর্ণনাতীত। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, মুসলিম তথা সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে মোদি সরকার যেন চাঁদ সদাগরের মতো নমো নমো করে বাম হাতে যেন মনসা পুজো দিচ্ছে।


২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, দেশে মুসলিম ১৭ শতাংশ (বেসরকারি হিসেবে অন্তত ২৫ শতাংশ), তপশিলী জাতি ১৬.৫ শতাংশ, উপজাতি ৮.৬ শতাংশ। অথচ ১৭ শতাংশ মুসলিম-সহ ২০ শতাংশ সংখ্যালঘুর জন্য বরাদ্দ মাত্র ৩০৯৭ কোটি টাকা। দেশের সংখ্যালঘু উন্নয়নে এই নাম কা ওয়াস্তে বরাদ্দ অর্থ খরচ করবে ২৮টি রাজ্য এবং ৯টা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। ২০১৮ সালের বাজেটে সংখ্যালঘু উন্নয়নে মোদি সরকার বরাদ্দ করেছিল ৪৭০০ কোটি। কিন্তু তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল যথাক্রমে ৬০ হাজার কোটি এবং ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও ২০০৬ সালে সাচার কমিটি এবং ২০০৭ সালে রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল এ দেশের মুসলিমদের অবস্থা কতখানি ভয়াবহ। ওই দুই রিপোর্টের সারমর্ম ছিল, দেশের ৯৫ শতাংশ মুসলিমই দারিদ্র্য সীমার নীচে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তপশিলি জাতি, উপজাতি, আদিবাসীদের থেকেও মুসলিমরা অনগ্রসর রয়ে গেছে। তবে মুসলিমরা পিছিয়ে রয়েছে নাকি তাদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে – সেই তর্কে না গিয়েও অবলীলায় বলা যায় বর্তমান কেন্দ্র সরকার কখনোই মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন চায় না। সেই আন্তরিকতা বা সদিচ্ছার অভাব প্রতিটা পদক্ষেপে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। একইসঙ্গে বাজেটের ছত্রে ছত্রে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ প্রতীয়মান হচ্ছে। এমনিতেই মুসলিমদের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, কারিগরি শিক্ষা প্রভৃতির জন্য এতকাল যেসব স্কলারশীপ ও ফেলোশীপ বা বৃত্তি/ঋণ ইত্যাদি চালু ছিল, ইতিমধ্যে সে সবের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে নমো সরকার।
২০১৫ সালে মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে সংখ্যালঘু উন্নয়নে মাত্র ৩৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৩৭৩৮ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য মুসলিম সহ দেশের এক-চতুর্থাংশ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য এই বরাদ্দ ভীষণ রকমের অপ্রতুল। অথচ সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মুসলিমদের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় থেকেও কম। তাই মুসলিমদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুপারিশ করেছিলেন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বাধীন কমিটি। তারপর ১৭ বছর পার হয়ে গেলেও মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণ সংখ্যানুপাতে কার্যকর হয়নি বা কেউ কথা রাখেনি। সাচার কমিটি বলেছিল, গ্রামীণ মুসলিমদের ৬০ শতাংশই এখনও ভূমিহীন। অথচ এখন উত্তরপ্রদেশ, অসম, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকারগুলো অকারণে কিংবা বানোয়াট অজুহাতে বুলডোজার চালিয়ে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মাদ্রাসা, মসজিদ সব ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অঘোষিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করে নেই রাজ্যের বাসিন্দা করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এই হাড় কাঁপানো শীতে তারা খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এই হল বিজেপির সবকা সাথ সবকা বিকাশের নমুনা।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর