
গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত বিশ্ব নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। কিন্তু বর্তমান বিশ্লেষণে উঠে আসছে নতুন প্রবণতা—আমেরিকার একক আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। পশ্চিমা শক্তিগুলির ভিত নড়বড়ে; ইউরোপ-আমেরিকার বদলে এখন বিশ্ব মঞ্চে এগিয়ে আসছে রাশিয়া, চীন, ভারত, তুরস্ক ও ইরানের মতো রাষ্ট্রগুলি। এই পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক নয়, বদলে দিচ্ছে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কৌশলগত সমীকরণ।
ষোড়শ শতকে পর্তুগাল ও স্পেনের হাত ধরে শুরু হয় উপনিবেশ স্থাপনের লড়াই। পরবর্তীতে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিগুলি এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকাজুড়ে সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় ইউরোপের প্রভাব কমতে থাকে, আর ১৯৪৫-এর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে নতুন “সুপারপাওয়ার”। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর (১৯৯১) আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২১ শতকে এই চিত্র পাল্টাচ্ছে।
বহু স্নায়ুযুদ্ধের পর রাশিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে নিজেকে পুনর্গঠিত করে। পুতিনের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া দখল (২০১৪), সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ (২০১৫), এবং ইউক্রেন যুদ্ধ (২০২২-বর্তমান) দিয়ে মস্কো জানান দেয়—পশ্চিমা প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখা সহজ নয়। অন্যদিকে চীন, “শান্তিপূর্ণ উত্থান” নীতি অনুসরণ করে, অর্থনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রোজেক্ট (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) চালু করে। বর্তমানে চীন-রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব পশ্চিমা জোটের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ন্যাটো জোটের মাধ্যমে আমেরিকা দীর্ঘদিন ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করলেও বর্তমানে এই জোটই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলিকে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ (ইরাক, সিরিয়া) ও অভিবাসন সঙ্কট ইউরোপের রাজনীতিতে ডানপন্থী শক্তির উত্থান ঘটিয়েছে, যা পশ্চিমা ঐক্যকে দুর্বল করছে।
২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) যোগদানের পর চীন বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয়। বর্তমানে তারা ৫জি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হুয়াওয়ে, টিকটক, আলিবাবার মতো কোম্পানিগুলি গ্লোবাল মার্কেটে আমেরিকান কর্পোরেশনগুলিকে টক্কর দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এবং তাইওয়ান প্রণালীতে সামরিক উপস্থিতি বেজিংয়ের আগ্রাসী ভূরাজনৈতিক অভিলাষের ইঙ্গিত দেয়।
পশ্চিমা জোটের সাবেক সদস্য তুরস্ক এখন রাশিয়া-চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছে। এরদোয়ানের নেতৃত্বে আঙ্কারা সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখ সংকটে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে ইরান, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ইয়েমেন, ইরাক ও লেবাননে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব বাড়াচ্ছে।
নতুন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কোয়াড (ভারত-আমেরিকা-জাপান-অস্ট্রেলিয়া) ও আইটিইউ (ইসরায়েল-ভারত-আমিরাত-যুক্তরাষ্ট্র) জোটের মাধ্যমে ভারত পশ্চিম ও এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করছে। তবে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়ানোর কৌশলও নিয়েছে নয়াদিল্লি।
আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্র আর একক নয়। অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কূটনীতিতে চীন-রাশিয়ার উত্থান, পশ্চিমের অভ্যন্তরীণ সংকট, এবং তুরস্ক-ইরানের মতো রাষ্ট্রগুলির সক্রিয়তা এক “বহুমেরু ব্যবস্থা” তৈরি করছে। এই প্রতিযোগিতায় কে হবে পরবর্তী “সুপারপাওয়ার”, তা নির্ভর করছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও কৌশলগত মিত্রতার উপর।