অভিন্ন দেওয়ানী বিধি কী, কেন?

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

Uniform-civil-code-reuters

~মুদাসসির নিয়াজ

গত ৯ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে প্রাইভেট মেম্বার বিল পেশ হয়। বিজেপি এমপি কিরোদি লাল মিনা বিলটি উত্থাপন করা মাত্রই একযোগে তীব্র আপত্তি করে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলগুলো। এবার গুজরাট বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে বিজেপি দেশজুড়ে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর ৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশ হলে গুজরাটে জেতার পরের দিনই রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন করা হল। যদিও গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারেও বিজেপি নেতৃত্ব ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনকী বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারেও ছিল এই প্রতিশ্রুতি। আবার বিজেপির অভিভাবক আরএসএস বা সংঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডাতেও শুরু থেকেই রয়েছে বিষয়টি। স্পর্শকাতর এই বিষয় নিয়েই কলম ধরেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক মুদাসসির নিয়াজ।

বিরোধীদের দাবি, এই ধরনের বিল সামাজিক বন্ধনকে নষ্ট করে দেবে। দেশে নতুন করে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হবে। যেমনটা হয়েছিল সিএএ ইস্যুতে। তাই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে। দেশে বৈচিত্রের মধ্যে যে ঐক্য ও সামাজিক সহাবস্থানের পরম্পরা রয়েছে, তাকেও নষ্ট করে দিতে পারে এই বিতর্কিত বিল। তাই বিরোধীরা এই বিলকে প্রত্যাহার বা তুলে নেওয়ার দাবি জানান। তবে রাজ্যসভার নতুন চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়ের হস্তক্ষেপে বিলের পক্ষে ৬৩ এবং বিপক্ষে ভোট পড়ে ২৩টি। উল্লেখ্য, অতীতেও এই বিলটি উত্থাপনের জন্য সংসদে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু রাজ্যসভা বা উচ্চকক্ষে তা উত্থাপন করা হয়নি।

কেন্দ্রীয় সরকারের সাফাই হল, এই বিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকারকে সুরক্ষিত করবে। এর মাধ্যমে জাতীয়স্তরে নজরদারি ও তদন্ত কমিটি তৈরির সুযোগ রয়েছে। ইউনিফর্ম সিভিল কোডকে বাস্তবায়িত করার জন্য এটাই প্রথম ও প্রধান ধাপ। তবে প্রাইভেট মেম্বার বিল থেকে আইন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এটি সরকার প্রস্তাব করেনি। এটি মূলত আলোচনার জন্য, দেশে জনমত গঠনের জন্য কার্যকর। তবে এভাবেই এই অতি স্পর্শকাতর ইস্যুতে আপাতত জল মেপে নিতে চাইছে গেরুয়া শিবির। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। যদিও কেন্দ্রীয় স্তরে অনেকটা ধীরে চলো নীতি নিয়েছে তারা। তবে গেরুয়া শিবির চায় সংসদে আলোচনা হলে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বাধ্য হবে। সেটিই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার সম্ভাবনা প্রবল। ৮ ডিসেম্বর গুজরাত ভোটে জেতার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাফ বলেন, এবার নিরপেক্ষদের মুখোশ খুলে দিতে হবে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে জনস্বার্থ মামলাগুলো দায়ের হয়েছিল, তা খারিজ করার আবেদন জানানো হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। তবে এই বিধি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তরফে কেন্দ্রের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে, কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক লিখিত বলেছে, আইনের চোখে এই রিট পিটিশন গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ পিটিশনার বা আবেদনকারী বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যগুলি দূর করে, ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর জন্য ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধেই নির্দেশনা চেয়েছেন৷ সংবিধানের নিয়ম মেনেই আইন ও আদালতের অবস্থান স্থির করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ীই সংসদ বা পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতা রয়েছে কোনও আইন প্রণয়ন করার। কোনও বাইরের কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে কোনও নির্দেশনা দিতে পারে না।

উল্লেখ্য, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির ভাগবণ্টন ইত্যাদি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলির জন্য বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন রয়েছে দেশে। এগুলো সব তুলে দিয়ে একটাই আইন বা দেওয়ানি বিধি চালুর পক্ষেই কেন্দ্র সরকার বা বিজেপি মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে। বিজেপি নেতা আইনজীবী অশ্বীনী উপাধ্যায় ২০১৯ সালে দেশজুড়ে সব জাতি-ধর্মের জন্য একই রকম নিয়ম চালুর জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর আবেদন জানিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন।

জনসঙ্ঘের সময় থেকেই গেরুয়া শিবিরের স্লোগান এক বিধান, এক প্রধান, এক নিশান। এই স্লোগানের মধ্যেই পড়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড। দেশের প্রথম রাজ্য হিসাবে বিজেপি-শাসিত উত্তরাখণ্ডে এই কাজ চলছে জোরকদমে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী সম্প্রতি জানিয়েছেন, ওই রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে। শীঘ্রই সেই কমিটি তাদের প্রথম খসড়া রিপোর্ট জমা দেবে। উত্তরাখণ্ডের ধাঁচেই অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর ভাবনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। মধ্য প্রদেশে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এই আইন চালুর জন্য পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন অমিত শাহ। কিন্তু এই বিল সংসদে এলেই, বিরোধের সম্ভাবনা প্রবল। তাই প্রথম ধাপে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আগে বিল পাশ করিয়ে আইন লাগু করে পরিস্থিতির আঁচ পাওয়ার চেষ্টা চলছে। পরে আগামী লোকসভা ভোটের আগেই তা সংসদে আনার ভাবনা। বিজেপি সেই পথেই হাঁটছে। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেটা হল বিজেপি শাসিত গোয়ায় পর্তুগিজ আমলের অভিন্ন দেওয়ানী বিধি বলবৎ রয়েছে। সেখানে কিন্তু কোনও হিন্দু পুরুষ নিঃসন্তান হলে দ্বিতীয় স্ত্রী রাখতে পারে বা দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন।

উল্লেখ্য, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক নেওয়ার মতো ক্ষেত্রে দেশে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা নিজস্ব আইন বা পার্সোনাল ল’ বলবৎ আছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ২০০ রকম জনজাতির মানুষ তাঁদের নিজস্ব আইন মেনে চলে। সংবিধানে নাগাল্যান্ডের নিজস্ব স্থানীয় বিধিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একই রকমের সুরক্ষা ভোগ করে থাকে মেঘালয় ও মিজোরাম। সংবিধান রচিত হয়েছিল মৌলিক অধিকার ও নির্দেশক নীতিমালার ভারসাম্যের ভিত্তিতে। এর মধ্যে কোনও একটির উপর অধিকতর গুরুত্ব আপোর করার অর্থ সংবিধানের মূল কাঠামো, অখণ্ডতা ও সংহতিকে বিশৃঙ্খল করা।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে সব জাতি ও ধর্মের সকলেই বিবাহ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে একইরকম পারিবারিক আইন মানতে বাধ্য হবেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডেরও অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার ১০ বছর আগে থেকেই (১৯৪৭) সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকেই মুসলিমদের ল বোর্ড চালু রয়েছে।

হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান থেকে শুরু করে আদিবাসী ও উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর ব্যক্তিগত আইন বা নিজস্ব দেওয়ানি বিধির সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনে নাবালক সন্তানের প্রথম অভিভাবক বাবা, দ্বিতীয় অভিভাবক মা। কিন্তু, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে জন্ম নেওয়া সন্তানের ক্ষেত্রে প্রথম অভিভাবক মা, দ্বিতীয় অভিভাবক বাবা। কোনও অভিভাবক যদি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেন, তাহলে তিনি অভিভাবকত্ব হারাবেন। পুত্র সন্তান না থাকলে হিন্দু দম্পতি পুত্র সন্তান দত্তকও নিতে পারেন। মুসলিম পার্সোনাল ল অনুযায়ী বিবাহ বহির্ভূত কোন সম্পর্ক নিষিদ্ধ। তাই সেই অবৈধ সম্পর্ক থেকে জন্মানো সন্তানের কোনও প্রসঙ্গই মুসলিম দেওয়ানী বিধিতে স্বীকৃত নয়। তাদেরও ব্যক্তিগত আইনে দত্তক নেওয়া যায়। কিন্তু, যাকে দত্তক নেওয়া হচ্ছে তাকে কখনই পুত্র বলা যায় না। এর অন্যতম কারণ হল, শরীয়াহ আইনে ঔরসজাত সন্তান ছাড়া অন্য কাউকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে না।

তেমনই কোনও সন্তান তার প্রকৃত জন্মদাতা ছাড়া অন্য কাউকে প্রকৃত বাবা হিসেবে মান্যতা দিতে পারে না। কোনো কারণে নিজের জন্মদাতা বাবাকে অস্বীকার করাও মুসলিমদের ক্ষেত্রে বৈধ নয়। কোনও মুসলিম ব্যক্তি স্ত্রী ও সন্তানের সম্মতি ছাড়া সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি অন্য কাউকে উইল করে দিতে পারেন না। হিন্দু ব্যক্তিগত আইনে বহুবিবাহের অনুমতি না থাকলেও মুসলিম আইনে সেটা আছে। তবে সেটা শর্ত সাপেক্ষে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। একেবারে ঢালাওভাবে একাধিক বিবাহের ছাড়পত্র দেয়নি ইসলাম ধর্ম। আবার খ্রিষ্টানদের ব্যক্তিগত আইনে স্বামী ধর্ম পরিবর্তন করলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারেন। পার্সি মহিলারা, নন-পার্সি কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। আবার নন-পার্সি কোনও মহিলা কোনও পার্সিকে বিয়ে করলে, স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক পান। সবটা পান না। এই বৈষম্য নিয়ে পার্সি সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিতর্ক রয়েছে। সবমিলিয়ে পুরো বিষয়টা খুবই জটিল।

সুতরাং একথা বলা যায়, রাজনৈতিক হীন স্বার্থে এই অভিন্ন দেওয়ানী বিধি লাগুর ভাবনা করা হলেও, নানা ভাষা, নানা মত, নানা জাতি, ননা ধর্মের এত বৈচিত্রময় দেশে এটা করা সমীচিনও নয়, সম্ভবপরও নয়। তবুও গাজোয়ারি করে করতে গেলে রক্তপাত ঘটবে। বহু মানুষের হয়ত প্রাণহানি হবে। তার বেশি লাভ কিছু হবে বলে মনে হয় না। সর্বোপরি সংবিধান প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন বা হরণ করা হবে।

নির্দেশমূলক নীতি
স্বাধীনতার পর ভারতীয় গণপরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা নিয়ে বিতর্ক হয়। বহু ধর্মীয় সম্প্রদায়, জনজাতির মানুষ যে দেশে থাকেন, যে দেশের সবেমাত্র নবজন্ম হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে শুরু থেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর পক্ষে রায় দেয়নি গণপরিষদ। উল্লেখ্য, ফৌজদারি আইন নিয়ে কোনও জাতি-ধর্মের মানুষ কোনকালেই আপত্তি করেনি। সবাই একবাক্যে দেশের ফৌজদারি সব আইন মাথাপেতে মেনে নিয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় প্রেক্ষিতে পারিবারিক ক্ষেত্রে কিছু দেওয়ানী আইন রয়েছে, যেগুলো নিজ নিজ ধর্মের স্বতন্ত্রতা রক্ষার প্রশ্ন। এই স্পর্শকাতর জায়গায় কুঠারাঘাত করলে শুধু মুসলিমরাই নয়, অন্যান্য বহু জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় রে রে করে উঠবে। তারা তাদের নিজস্বতা, স্বতন্ত্রতা ও স্বকীয়তা রক্ষার্থে হয়ত শেষমেশ জীবন বাজি রাখতেও পারে। কারণ এটা তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

আর একটা ব্যাপার হল, বর্তমানে দেশের মূল সমস্যা কিন্তু কোন ধর্ম বা জাতের মানুষ কীভাবে বিয়ে করছে বা ডিভোর্স দিচ্ছে সেটা নয়। দেশের মূল সমস্যা অন্যত্র। সেগুলো হল মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি, লাগামছাড়া বেকারত্ব ও কর্ম সংস্থান সুনিশ্চিত করা, জনগণের জীবন ও বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করা, সংবিধান প্রদত্ত সব রকমের অধিকার সুনিশ্চিত করা, সর্বোপরি দেশবাসীকে সুশাসন দেওয়া। অসাম্য, বৈষম্য ঘোচানো। দেশ থেকে ঘৃণা, বিদ্বেষের বাতাবরণ মুক্ত করা। সবার হাতে কাজ চাই, সবার পাতে ভাত চাই। দশতলা আর গাছতলার ব্যবধান ভারসাম্যপূর্ণ করার চেষ্টা। সেসব না করে বর্তমান কেন্দ্র সরকার কেবলই একচোখা নীতি নিয়ে চলেছে।

দেশ চালাতে সরকারের নীতি কী হবে। সংবিধানের ৩৬ থেকে ৫১ নম্বর অনুচ্ছেদে তা স্পষ্ট বলা আছে। যাকে বলা হয়, নির্দেশমূলক নীতি। এই নির্দেশমূলক নীতির ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদ বলছে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু এই বিধি কি ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকার ভঙ্গ করবে? রয়েছে এ প্রশ্নও। পাশাপাশি এ প্রশ্নও রয়েছে যে, অভিন্ন দেওয়ানী বিধি চালু হলেই আমাদের দেশ কি সোনায় সোহাগা হয়ে যাবে? স্থান কাল পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন দেওয়ানী বিধি চালু থাকায় দেশ কি অনুর্বর হয়ে রয়েছে? দেশের কি কোনও উন্নতি-প্রগতি হয়নি? নাকি সব উন্নতির পথে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে ভিন্ন দেওয়ানী বিধি? এটা তুলে দিয়ে অভিন্ন বিধি লাগু করলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আরেকটি ব্যাপার হল সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিমালায় তো মদ তুলে দেওয়ার কথাও লেখা রয়েছে। কই, কোনও সরকার তো সে দিকে নজর দেয়নি বা দিচ্ছে না। অথচ আমরা জানি, দেশে যত রকমের অপরাধ সংঘটিত হয় বা দুর্ঘটনা ঘটে তার সিংহভাগ কারণ হল মদ। এই মদ হল অপরাধের জননী। তাই ইসলাম ধর্মে মদকে হরাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

১৯৭৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয় নির্দেশমূলক নীতি প্রয়োগ করার জন্য আইন তৈরি হলে তা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী বলে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। গণপরিষদে, মুসলিম সদস্যরা চাননি যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হোক। আবার হিন্দু সদস্যরাও যে সবাই চেয়েছিলেন, এমনটাও কিন্তু নয়। সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন, কোনও সরকারেরই উচিত হবে না এভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা, যাতে মুসলিম সহ অন্যেরা বিদ্রোহ করেন। আবার গণপরিষদ সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের মত ছিল, মুসলিমদের প্রগতিশীল করার জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হলে তা হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া, মদনমোহন মালব্য, কৈলাসনাথ কাটজুরা সেদিন হিন্দু আইন সংস্কারের বিরোধিতাই করেছিলেন।

রাজ্য কি পারে?
দেশের কোনও রাজ্য কি আলাদাভাবে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করতে পারে? যখন কোনও কেন্দ্রীয় আইনই নেই, তখন কীভাবে পারে? যেমন, উত্তরাখণ্ড বলছে। এনিয়েও রয়েছে দ্বিমত-বিতর্ক। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক, উত্তরাধিকারের মতো দেওয়ানি বিধির গোড়ার বিষয়গুলি সংবিধানে যৌথ তালিকায় রয়েছে। যৌথ তালিকায় থাকা কোনও বিষয়ে রাজ্যের আইনের সঙ্গে কেন্দ্রের আইনের সংঘাত তৈরি হলে রাজ্যের আইন বাতিল হয়ে যায়। তবে, রাজ্যের ওই আইনে যদি রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেন, তাহলে সেই আইন চালু থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও রাজ্য যদি এই বিধি পাস করায়, তা হলে আইনের সঙ্গে সংঘাত বাধতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজ্যওয়াড়ি ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাগবে। যা বেনজির বা নজিরবিহীন। সংবিধানে নির্দেশমূলক নীতিতে বলা আছে রাষ্ট্র সমগ্র দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করবে। এখানে স্টেট শব্দের অর্থ কেন্দ্র; রাজ্য কিন্তু মোটেই নয়। সুতরাং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে এই বিধি নিয়ে যে খেলা চলছে, তা কখনোই কাম্য নয়। কারণ, সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে ব্যক্তির ধর্মীয় মৌলিক অধিকার স্বীকৃত। সংবিধানের ২৬ (বি)-তেও সে কথাই বলা হয়েছে। আবার ২৯ নং অনুচ্ছেদে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই সব জাতি-ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তারা চরৈবেতি মন্ত্রে দীক্ষিত হোক। কেন্দ্র সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, তাদের বোধোদয় হোক।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর