শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২৫: বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারিকরণের ধারাবাহিক আঘাত
২০২৫ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ করেছে, তা স্পষ্টভাবে দেখায় যে বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে জনসেবার পরিবর্তে একটি বাজারজাত পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। সরকারি শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়ন ও গবেষণায় বরাদ্দ হ্রাসের বিপরীতে কর্পোরেট ও বেসরকারি উদ্যোগের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে। এই বাজেট সরকারের সেই প্রতিশ্রুত “১০০ শতাংশ উন্নত মানের স্কুলশিক্ষা” এবং “অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি” বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা প্রকাশ করছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির (NEP) আলোকে বিদ্যালয় শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার ছিল, কিন্তু এই বাজেটে স্কুল শিক্ষার জন্য বরাদ্দ মাত্র ৭.৬% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে দেখলে প্রকৃতপক্ষে কোনো উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি নয়। সর্বাধিক উদ্বেগজনক বিষয় হল মিড ডে মিল প্রকল্পের (PM-POSHAN) জন্য বরাদ্দ প্রায় অপরিবর্তিত থাকায়, প্রতিদিন শিশুপ্রতি মাত্র ৫ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। অথচ ভারতের ৩৬% শিশু খর্বকায় এবং ১৭% শিশু কম ওজনের, যা পুষ্টিহীনতার গভীর সংকটের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের বরাদ্দও কমানো হয়েছে, যা মা ও শিশুর পুষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের চরম অবহেলার প্রমাণ।
উচ্চশিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ ৫% বৃদ্ধি পেলেও, ৫.২২% মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে প্রকৃত অর্থে কোনো বৃদ্ধিই হয়নি। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, উচ্চশিক্ষার জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১% এরও কম। গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সরকারি তহবিল ৭.৮৯% কমানো হয়েছে, অথচ বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ২০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে সরকার বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে কর্পোরেট ও বাজারের হাতে তুলে দিচ্ছে এবং সরকারি গবেষণাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির নামে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার বরাদ্দ ৭৩% কমিয়ে ৪৭৫.১২ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এটি মূলত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ধাপে ধাপে পেছনে ঠেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির আধিপত্য তৈরি করার ষড়যন্ত্র। এর পাশাপাশি, আইআইটি, আইআইএম এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য মূলধনী ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার শিক্ষাকে একটি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, যেখানে ধনী ও প্রভাবশালীদের জন্য উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে, কিন্তু প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্য শিক্ষাকে দুর্লভ করে তোলা হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রদত্ত অনুদানের ৩% এর বেশি উচ্চশিক্ষা অর্থায়ন সংস্থা (HEFA)-র ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। এর ফলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কর্পোরেট ঋণের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা তাদের স্বায়ত্তশাসন ও গবেষণার স্বাধীনতাকে সংকটের মুখে ফেলবে।
বিশেষত, এই বাজেটে এক অজানা “ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র” খাতে বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা থেকে ৫০ কোটি টাকায় বাড়ানো হয়েছে, যা মূলত হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এটি শিক্ষাব্যবস্থার উপর চরম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।
২০২৫ সালের বাজেট স্পষ্টভাবে দেখায় যে সরকার শিক্ষার অধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য না করে একে একটি বিলাসিতা ও বাজারের নিয়ন্ত্রণাধীন পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। শিক্ষা খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করছে, যেখানে কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত ও কর্পোরেট সংস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণি মানসম্পন্ন শিক্ষা লাভ করতে পারবে।
এই বাজেট শিক্ষা খাতের বেসরকারিকরণ, গবেষণা খাতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকটকে ত্বরান্বিত করবে, যা ভারতীয় সমাজে দীর্ঘমেয়াদে এক গভীর বিভাজন সৃষ্টি করবে। এটি শিক্ষার অধিকারকে ধ্বংস করার এবং গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর ভিত্তিকে দুর্বল করার এক সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। তাই, এই শিক্ষাবিরোধী বাজেটের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।