
আরুণগুনাম গ্রাম, তিরুভন্নামালাই, তামিলনাড়ু : কৃষি-জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করে তামিলনাড়ুর আরুণগুনাম গ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের কৃষকদের ওপর উচ্চবর্ণীয় হিন্দু রেড্ডিয়ার সম্প্রদায়ের সশস্ত্র আক্রমণ ও ড্রোনের মাধ্যমে বিষ স্প্রে করে ফসল ধ্বংসের ঘটনায় উত্তাল গোটা অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে দলিতদের জন্য বরাদ্দ ‘পঞ্চমী’ বা ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ জমি দখল নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধে এবার যোগ হলো ড্রোনের মাধ্যমে ফসলে বিষ ছিটানোর নয়া কৌশল। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও পুলিশের গাফিলতির অভিযোগে প্রতিবাদে সরব হয়েছে বামপন্থী সংগঠনগুলি, বিশেষত সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে চলছে আইনি লড়াই।
২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, রেড্ডিয়ার সম্প্রদায়ের নেতা কে. হার্ষবর্ধিনীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জন সশস্ত্র গুন্ডা ড্রোনের মাধ্যমে সেসম ও কালো ছোলার ফসলে হার্বিসাইড (কীটনাশক) ছিটিয়ে দেয়। প্রায় ৭ একর জমির সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হয়, যা বাজারমূল্যে প্রায় ২ লক্ষ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এম. সুকুমার, এম. থিলাকরাজ ও ভি. আন্নামালাই জানান, জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ৬ মাস আগে এই পঞ্চমী জমি তাদের দখলে এলেও উচ্চবর্ণীয় গোষ্ঠী বারবার হামলা চালাচ্ছে।

১৮৯২ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে দলিতদের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে ‘ডিপ্রেসড ক্লাস ল্যান্ড অ্যাক্ট’ (জিও নং ১০১০) প্রণয়ন করা হয়। তিরুভন্নামালাইসহ সমগ্র তামিলনাড়ুতে ১২ লক্ষ একর ‘পঞ্চমী জমি’ বরাদ্দ দেওয়া হয় দলিত পরিবারগুলিকে, যা বিক্রি বা হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাল দলিল, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রশাসনের সমর্থনে উচ্চবর্ণের লোকেরা এই জমি দখল করতে থাকে। সুকুমারের দাদা এস. চিন্নাথাম্বির নামে থাকা জমি (সার্ভে নং ২১৬/১-৩) একাধিকবার হস্তান্তরের পর শেষ পর্যন্ত রেড্ডিয়ার সম্প্রদায়ের এন. করুণাকরণের স্ত্রী হার্ষবর্ধিনীর দখলে চলে যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সুকুমার, যিনি নিজে একজন আইনজীবী ও সিপিআই(এম) কর্মী, তার বক্তব্য “গ্রামে দলিতদের প্রতি বৈষম্য চিরাচরিত। আমাদের পরিবারের মতো প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা আইন শিখে এই লড়াইয়ে নেমেছি। প্রশাসন যদি ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা মাঠ থেকে রাজপথ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাব।”
সিপিআই(ম) পার্টির এবং ‘অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ফ্রন্ট’-এর চাপে ২০২৪ সালে চেইয়ার রেভিনিউ বিভাগের তদন্তে নিশ্চিত হয়, জমিটি পঞ্চমী শ্রেণির। তবে অনলাইন রেকর্ডে হালনাগাদ না করায় উভয় পক্ষই দাবিদার। সিপিআই(এম)-এর আইনি সহায়তায় ম্যানুয়াল পাট্টা (জমির দলিল) দলিত পরিবারের নামে ফেরত এলেও প্রশাসনের জটিলতায় সংঘাত থামছে না।
উল্টোদিকে, হার্ষবর্ধিনী দলিত কৃষকদের বিরুদ্ধে ‘তামিলনাড়ু নারী নির্যাতন নিষেধ আইন’-এ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন , যা সংঘাতকে আরও জটিল করেছে। অন্য একজন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক থিলাকরাজের অভিযোগ, “ফসল নষ্টের প্রতিবাদে আমরা এসসি/এসটি অ্যাট্রোসিটি আইনে অভিযোগ করলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং শান্তি বিঘ্নিত’ হওয়ার অজুহাতে আমাদের জমিতে চাষ বন্ধ করতে বলা হয়েছে।”
চেয়ার উপ-কালেক্টর পল্লবী ভার্মার তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখনো তদন্ত ও অনুসন্ধান হয়নি বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা।
তামিলনাড়ুর মোট ১২ লক্ষ একর পঞ্চমী জমির মধ্যে প্রায় ৭০% আজ উচ্চবর্ণীয় সম্প্রদায় বা কর্পোরেটদের দখলে। ১৯৯১ সাল থেকে একাধিক রাজ্য কমিটি গঠন করা হলেও জমি উদ্ধারের উদ্যোগ হয়নি বললেই চলে। বরং এসইজেড বা শিল্প প্রকল্পের নামে এই জমি বেসরকারি সংস্থাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যা দলিতদের ভাগ্যবিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করছে।
দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের এই ঘোর সংকটে সিপিআই(এম)-এর ভূমিকা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। দলিত কৃষকদের সংগঠিত করে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি তারা রাজ্যব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে। দলীয় মুখপাত্র জানান, “জমি দখল কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। আমরা জমির অধিকার থেকে শিক্ষা-চিকিৎসা পর্যন্ত দলিতদের স্বার্থে লড়াই জারি রাখব।”
এই ঘটনা প্রমাণ করে, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির সমন্বয় ছাড়া দলিত মুক্তি অসম্ভব। প্রশ্ন ওঠে—উচ্চবর্ণের আধিপত্য ও পুঁজির শক্তি যখন প্রশাসন-পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন কি সংবিধানের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি কাগুজে ব্যাঙের ছাতা হয়ে থাকবে? এই লড়াইয়ে সিপিআই(এম)-এর মতো বামপন্থী শক্তিই কি শেষ ভরসা?