
সবচেয়ে বড় মিষ্টিজলের উৎস আমাজন নদী আজ সংকটের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বন ধ্বংসের কারণে এই নদীর জলস্তর ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমাজন রেইনফরেস্টের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে বৈশ্বিক জলবায়ুতে অপরিমেয় ক্ষতি হতে পারে।
খরার কারণ: প্রাকৃতিক নাকি মানবসৃষ্ট?
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাজন অঞ্চলের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে মাটি ও গাছপালা থেকে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার হার বেড়ে গেছে। ২০২৩ সালে এল নিনো প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই অঞ্চলে ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে।
২. বন ধংসের ভূমিকা: গত ৫০ বছরে আমাজনের ২০% বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। গাছপালা কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমেছে। বনভূমি বাতাসে আর্দ্রতা ধরে রেখে মেঘ তৈরি করতে সাহায্য করে। কিন্তু বন উজাড় হওয়ায় এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, যা খরাকে তীব্র করছে।
৩. প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ ভূমিকা
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু প্রাকৃতিক কারণেই নয়, অবৈধ বন কাটা, কৃষির জন্য জমি দখল ও কয়লা খনির মতো মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড খরাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
নদীর জলস্তর পতন: কী ঘটছে আমাজনে?
- ব্রাজিলের পোর্তো ভেলহো শহরের কাছে আমাজনের উপনদী মাদেইরা-র জলস্তর মাত্র ৪৮ সেন্টিমিটার এ নেমে এসেছে, যা নৌ চলাচল অসম্ভব করে তুলেছে।
- সোলিমোস নদীর একটি শাখা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। কলম্বিয়া সীমান্তের কাছে এই নদীর জলস্তর রেকর্ড সর্বনিম্নে পৌঁছেছে।
- টেফে হ্রদ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে বসবাসকারী ২০০টিরও বেশি গোলাপি ডলফিন মারা গেছে। এই হ্রদ ছিল জলজ প্রাণীদের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল।
জলচক্রের বিঘ্ন:
আমাজনের গাছপালা বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করে একটি স্বয়ংক্রিয় জলচক্র বজায় রাখে। কিন্তু বন ধ্বংস ও খরার কারণে এই চক্র ভেঙে পড়ছে। ফলে আমাজন অঞ্চল ক্রমশ শুষ্ক ও উষ্ণ হয়ে উঠছে, যা দক্ষিণ আমেরিকার জলবায়ুকেও প্রভাবিত করছে।
জীববৈচিত্র্য ও মানুষের উপর প্রভাব:
১. প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষতি:
- জলস্তর কমায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। শুধু ডলফিন নয়, কচ্ছপ, মাছ ও জলজ উদ্ভিদও হুমকির মুখে।
- শুকনো মাটিতে দাবানলের ঘটনা বাড়ছে, যা বনভূমি আরও ধ্বংস করছে।
২. স্থানীয় জনজীবন:
- নদীপথে পরিবহন বন্ধ হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামে খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছানো কঠিন হয়েছে।
- মৎস্যজীবীদের income কমেছে, কৃষিজমিতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
ভবিষ্যৎ কী বলছে বিজ্ঞান?
- গবেষণা বলছে, ২০২৬ সাল নাগাদ আমাজনের অনেক অংশে দীর্ঘমেয়াদি খরা শুরু হতে পারে।
- বর্তমান হারে বন ধ্বংস হলে ২০৫০ সালের মধ্যে আমাজনের ৪০% এলাকা সাভানায় পরিণত হতে পারে।
- আমাজন এখন কার্বন শোষণের বদলে কার্বন নিঃসরণের উৎস হয়ে উঠছে! গাছপালা কমে যাওয়ায় সংরক্ষিত কার্বন বাতাসে মিশে উষ্ণায়ন বাড়াচ্ছে।
সমাধানের পথ
১. **বন সংরক্ষণ: ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও বর্তমান খরা মোকাবিলায় তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
২. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: আমাজন শুধু ব্রাজিলের নয়, গোটা বিশ্বের সম্পদ। তাই এই অঞ্চলের সুরক্ষায় উন্নত দেশগুলোর আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য প্রয়োজন।
৩. স্থানীয় উদ্যোগ:
- বন পুনরুদ্ধার প্রকল্প জোরদার করা।
- কৃষকদের পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ শেখানো।
- জল সংরক্ষণের জন্য আধুনিক পদ্ধতি চালু করা।
আমাজন নদী ও রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। কিন্তু এই ফুসফুস আজ অক্সিজেন দেওয়ার বদলে কার্বন নিঃসরণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বন ধ্বংসের বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অস্থিতিশীল পৃথিবীর মুখোমুখি হবে। বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলছেন—প্রকৃতির সাথে সমন্বয় করে স্থায়ী-স্থিতিশীল উন্নয়নই একমাত্র পথ।