
নয়াদিল্লি:ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মাঝেই একটি বড় কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রিয় সরকার। পাকিস্তানকে সমর্থনকারী আজারবাইজানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আর্মেনিয়াকে সামরিক সহায়তা করতে সম্পুর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আকাশ-১ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম চারটি ইউনিট আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানে পৌঁছে যাবে।
ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের এক জটিল কূটনীতি। গত বেশ কয়েক মাস ধরে আজারবাইজান সরকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। এমনকি আজারবাইজানের রাষ্ট্রদূত খালিদ আলিয়েভ গত ফেব্রুয়ারিতে ইসলামাবাদে এক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, “কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।” এই বিবৃতি দেওয়ার পরই ভারত সরকার আর্মেনিয়াকে সামরিক সহায়তার হাত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
দীর্ঘদিন ধরে চলছে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে। ২০২০ সালে এই সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে আর্মেনিয়া ভারতের কাছে সামরিক সহায়তা চায়। এই চলমান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতেই, ২০২০ সালেই ভারতের সঙ্গে ৭২ কোটি ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে আর্মেনিয়া। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত আর্মেনিয়াকে ১৫টি আকাশ-১ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সরবরাহ করবে।
আকাশ-১ ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর তৈরি একটি অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এই সিস্টেম ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাল্লার মধ্যে যেকোনো শত্রু বিমান, ড্রোন বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করে ধ্বংস করতে সক্ষম। ২০২২ সালে অপারেশন সিন্ধুতে পাকিস্তানি ড্রোন হামলা ঠেকাতে এই ব্যবস্থার বিশেষ সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি হবে ভারতীয় তৈরি আকাশ-১ সিস্টেমের প্রথম বিদেশি রপ্তানি। দ্বিতীয়ত, এটি আজারবাইজান-তুরস্ক-পাকিস্তান জোটের বিরুদ্ধে ভারতের কৌশলগত জবাব। তৃতীয়ত, এটি বিশ্ব বাজারে ভারতীয় অস্ত্র শিল্পের সক্ষমতা প্রমাণের একটি সুযোগ।
ইতিমধ্যেই আর্মেনিয়াকে ভারত পিনাকা রকেট লঞ্চার এবং কিছু রাডার সিস্টেম সরবরাহ করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আকাশ সিস্টেমগুলো মোতায়েন করা হবে লাচিন করিডোরের কাছাকাছি স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে।
আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতীয় প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।” আর্মেনিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম আরমেনিয়ান টাইমস জানিয়েছে, এই সিস্টেম পেয়ে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী হবে।
ভারতের এক সাবেক সেনা অফিসার কর্নেল বিক্রম সিং (অব.) এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে আমরা ইসরায়েলের কাছ থেকে জরুরি অস্ত্র পেয়েছিলাম। আজ আমরা অন্য দেশকে সাহায্য করছি – এটাই ভারতের নতুন সামরিক শক্তির পরিচয়।”
ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য এটি একটি বড় মাইলফলক। গত কয়েক বছরে ভারতীয় অস্ত্রের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধেই ভারত ১.২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আর্মেনিয়াকে আকাশ সিস্টেম রপ্তানি এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
এদিকে, ডিআরডো ইতিমধ্যেই আকাশ সিস্টেমের আরও উন্নত সংস্করণ আকাশ-এনজি নিয়ে কাজ করছে, যার পাল্লা হবে ১৮০ কিলোমিটার। সূত্রে জানা গেছে, আর্মেনিয়া ইতিমধ্যেই এই উন্নত সংস্করণ ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এই ঘটনাকে ঘিরে কূটনৈতিক মহলে এখন উত্তপ্ত আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আজারবাইজান যদি পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে ভারতের জন্য আর্মেনিয়াকে সমর্থন করা একটি যৌক্তিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত শুধু সামরিক নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।

প্রসঙ্গত, ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় আর্মেনিয়া ভারত ও ফ্রান্সের দিকে ঝুঁকছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জন্য আর্মেনিয়াকে সমর্থন করা একটি বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
এই পুরো ঘটনাটি প্রমাণ করছে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটবদ্ধতা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ভারতও এই খেলায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে এবং নিজের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব কৌশলই প্রয়োগ করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের কৌশলগত জোট আরও বাড়বে।