পশ্চিমবঙ্গে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রের উপর হামলা: ট্রেনে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে অত্যাচার উগ্রহিন্দুত্ববাদীদের
তারিখ: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ |
এই রাজ্যেই ট্রেনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ বছর বয়সী এমটেক ছাত্র রেজাউল ইসলাম মণ্ডলকে ১০-১২ জন হিন্দুত্ববাদী যুবকের দল চরমভাবে আক্রমণ করে। এই ঘটনাটি গেদে স্টেশন থেকে শিয়ালদাহগামী ট্রেনে সংঘটিত হয়। রেজাউল বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমা থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে উঠেছিলেন। একটি ট্রলি ব্যাগ লাগেজ র্যাক থেকে নামানোর অনুরোধের পর থেকেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়। যদিও রেজাউল বিনা প্রতিবাদে ব্যাগ সরিয়েছিলেন, কিছু যাত্রী তাকে জোর করে সিট থেকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং ধর্মকে টেনে গালিগালাজ শুরু করে। আক্রমণকারীরা তাকে “বাংলাদেশি” বলে উস্কানি দেয় এবং প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লাথি-ঘুষি, দাড়ি টানা, টুপি খুলে ফেলার মতো ঘৃণ্য নির্যাতন চালায়। এমনকি চলন্ত ট্রেন থেকে তাকে ফেলে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় ।
রেজাউলের বন্ধু সাজিদ মির্জা যখন ভিডিও ধারণ করার চেষ্টা করেন, তখন তার ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাকেও হুমকি দেওয়া হয়। সাজিদের বক্তব্য, “তারা আমাদের অশিক্ষিত সন্ত্রাসী বলে গালি দিয়েছে, যারা দেশ ধ্বংস করছে” ।
ঘটনার পর রেজাউল প্রথমে হরিপাল থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলেও পুলিশ তা নথিভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি শিয়ালদাহ রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) তার অভিযোগ গ্রহণ করে এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ১১৫(২), ২৯৯, ৩৫১(২), এবং ৩(৫) অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয় । তবে, দুই দিন পরও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানা গেছে ।
এই ঘটনায় রাজ্য ও জাতীয় স্তরের নেতারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতা বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য্য বলেছেন, “এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আরএসএস-ঘনিষ্ঠ রাজ্যগুলোতে এমন ঘটনা বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশক ধরে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে” ।
ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের নওশাদ সিদ্দিকী প্রশ্ন তোলেন, “দাড়ি-টুপি পরাই কি অপরাধ? গণতান্ত্রিক দেশে এমন হামলা অগ্রহণযোগ্য” ।
অল বেঙ্গল মাইনরিটি ইয়ুথ ফেডারেশন-এর মো. কামরুজ্জামান সতর্ক করেছেন, “ট্রেনে আগেও মুসলিম যুবকদের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা চলতেই থাকবে” ।
এই রকম ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে ক্রমবর্ধমান ভাবে বেড়ে চলে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মুর্শিদাবাদে কার্তিক পুজোর সময় একটি নিয়ন সাইনবোর্ডে আপত্তিকর বার্তা লিখার অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল, যাতে ৬ জন আহত হন ।
গত দুই সপ্তাহে ১২টি মব লিঞ্চিং জুন ২০২৪-এ পশ্চিমবঙ্গে চারজনকে চোর বলে সন্দেহে হত্যা করা হয় এবং ১০ জন আহত হন ।
এর আগেও ২০২৩ সালে চন্দননগরে শেখ নজরুল নামক এক মুসলিম যুবকের মব লিঞ্চিং এবং সোনারপুরে মানবাধিকার সভায় হামলার ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি দাবি করেছে যে রাজ্য সরকার ও রেল কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন:
অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর)-এর রঞ্জিত সুর বলেছেন, “এটি হিমশৈলের চূড়া মাত্র। রাজনৈতিক দল ও মিডিয়া রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করেছে” ।
সামাজিক কর্মী ইমতিয়াজ আহমেদ মোল্লা বলেছেন, “উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের মতো পরিস্থিতি এড়াতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে” ।
রেজাউল ইসলামের ঘটনা শুধু একটি হামলা নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গের ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং আইনি প্রক্রিয়ার গতিহীনতা এই সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। একটি শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং প্রশাসনের তৎপরতাই কেবল এই চক্র ভাঙতে পারে।