ক্যারাটেতে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করা আয়েশা, নিজের ঘর কলকাতায় এখনো স্বীকৃতির সন্ধানে

সাইফুল্লা লস্কর : ২১ বছর বয়সী ব্ল্যাক বেল্ট আয়েশা নূর, ৮ বছর বয়সে ক্যারাটে শেখা শুরু করেছিলেন। জন্মের পর থেকেই মৃগী রোগে আক্রান্ত, ঠিক তারপরেই পিতাকে হারিয়ে দারিদ্র্যের বন্ধনে আবদ্ধ আয়েশা কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি যে তিনি কখনও ক্যারাটেতে স্বর্ণপদক লাভ করতে পারবেন। তবে এমএ আলীই তাকে কলকাতার বেনিয়াকুপুর বস্তি থেকে তাঁর ডানাতে নিয়ে গিয়ে ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন।

আয়েশা নুর ২০১০ সালে জাতীয় স্তরে মুম্বাইয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জিতে তার কোচকে গর্বিত করেছিলেন।

২০১১ সালে তিনি মুম্বাইয়ের ১৫ তম আন্তর্জাতিক ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে (তরুণ গ্রুপ) স্বর্ণপদক জিতেছিলেন, যেখানে বেশ কিছু দেশের ক্রীড়াবিদরা অংশ নিয়েছিল। ২০১১ ও ২০১২ সালে তিনি দুবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন যেটা তার কাছে ছিল অনেক বড় একটা আর্জন।

তার বাবা, যিনি একজন ট্রাক চালক ছিলেন, তার মা শাকিলা বেগম বাসায় কাপড় সেলাই করার সময় তার বড় ভাই রাস্তার পাশে জুতার দোকানে কাজ করতেন। আয়েশারা ও তার মা-বাবা, ভাই-বোন মিলিয়ে মোট ৬ জন একটি মাত্র ছোট রুমে বাস করেন।

শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে তার কোচের করা আবেদনের ফলে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের জন্য ব্যাংককে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল একত্রিত করা হয়েছিল এবং আয়েশা সমস্ত রাউন্ডে জিতে ফাইনালে তিনি তার জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে ট্রফি জিতেছিলেন। তারপর তিনি ‘কলকাতার গোল্ডেন গার্ল’ উপাধি অর্জন করেন। ২০১৫ সালে তিনি ব্যাংককে দ্বিতীয় বার সোনা জিতেছিলেন।

তার প্রচেষ্টায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত রাষ্ট্রগুলির দ্বারা স্বীকৃত ২০১৭ সালে নয়াদিল্লির আমেরিকান সেন্টারে আয়েশা নূরকে “জেনারেল ইক্যুয়ালিটির বীর” হিসাবে সম্মানিত করা হয়েছিল। এর এক বছর পরে “গার্ল কানেক্টেড” নামে আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সিরিজ (আইটিভিএস) এবং বিশ্বব্যাপী পর্দা তৈরি করে কলকাতার বস্তি থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বর্ণ জয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর যাত্রা সম্পর্কিত একটি ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছিল। এটি দূরদর্শন (দিল্লি) দ্বারা প্রচারিতও হয়েছিল।

‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপও আয়েশাকে ২০১৯ সালে ‘টাইমস উইমেন হিরোস অ্যাওয়ার্ড’ হিসাবে সম্মানিত করেছে।

আত্মরক্ষার শিল্পে আয়ত্ত করা তার কৃতিত্বের সাথে আয়েশা সন্তুষ্ট নন। তার শহরের বস্তি থেকে আরও মেয়েদের নিজ খরচায় আত্মরক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত তিনি ২০০ এরও বেশি মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য হ’ল প্রত্যেকটি মেয়ে প্রতিদিন যে ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে তার কারণে নিজেকে রক্ষা করতে শেখাটা অত্যন্ত আবশ্যক। গত ৭ বছর থেকে তিনি মেয়েদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন।

আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সম্মেলন ২০১৯ এ ব্যাংককে আয়েশা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিল।

২০২০ সালে কলকাতার ‘সোনার মেয়ে’, নামক একটি মিডিয়া হাউজ তাকে ‘তেজস্বিনী’ পুরষ্কার দিয়েছিল। তিনি জি ২৪ ঘন্টা দ্বারা ‘স্বয়সিদ্ধা’ পুরষ্কারও পেয়েছিলেন।

আয়েশার জীবন নিয়ে “লাথি মেরে বেঁচে থাকা” শীর্ষক আর একটি ডকুমেন্টারি সেন্ট জেভিয়ারস কলেজের মাসকম (গণযোগাযোগ) বিভাগ দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। এই ডকুমেন্টারিটি জিআইএফএ পুরস্কার জিতেছে।
দিনে দিনে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল এবং সংবাদপত্রের জন্য তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ইউটিউবে তার বেশ কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ রয়েছে।

আয়েশা নূর তার বেল্ট অধীনে বেশ কয়েকটি পুরষ্কার দিয়ে সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার স্বাদ পেয়েছেন। তবে তার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তার কোচ মোহাম্মদ আক্তার আলী মনে করেন, তিনি তার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং তার দেশ ভারত দ্বারা স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তবেদুঃখের বিষয় তার নিজের জন্মভূমি এখনও তার প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি।

তার মা তার ওষুধের ব্যয় বহন করে যা তাকে মৃগী রোগের জন্য অবিরাম নিতে হয়।“সরকার তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে তবে আয়েশার কৃতিত্ব কোনওভাবেই একটি ছোট কীর্তি নয়। তিনি যেখানেই ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেখানে সর্বদা জয়ী হয়েছেন ”, বলে জানান তার কোচ আক্তার আলী।

তার একটি ডকুমেন্টারি পরিচালক আয়েশা এবং তার প্রচেষ্টা সমর্থন করার জন্য ২০১৫ সালে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তার বক্তব্যে তিনি দুঃখের সাথে যোগ করেছেন “আমরা কেবল আশ্বাস পেয়েছি এছাড়া অন্য কিছুই নয়।’

এদিকে, আয়েশা নূর আমাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। আয়েশা তার সাফল্যের কৃতিত্ব তার কোচ এম এ আলির কাছে, যিনি তাকে বিনামূল্যে শিখিয়েছিলেন এবং তাকে নায়ক এবং লিঙ্গ সমতার ক্রুসেডার তৈরি করেছিলেন তার কাছে অর্পণ করেছেন। তবে তার পরিবারও তার সমান সমর্থনকারী। আয়েশা হ’ল একটি সরল, নির্মম মেয়ে, যিনি প্রতিটি মেয়েকে আত্মরক্ষার কৌশল দিয়ে সশস্ত্র করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন।

Latest articles

Related articles