
উত্তরপ্রদেশের মিরাটে ঘটে যাওয়া মার্চেন্ট নেভি অফিসার সৌরভ রাজপুতের হত্যাকাণ্ড সমগ্র দেশকে স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। স্ত্রী মুসকান রাস্তোগি ও তার প্রেমিক সাহিল শুক্লার পরিকল্পনায় শুধুমাত্র হত্যাই নয়, দেহকে কুচি কুচি করে ১৫ টুকরো করে সিমেন্ট-বন্দী ড্রামে লুকানোর নৃশংসতা এই মামলাকে বিভৎস ভয়ংকর করে তুলেছে। পুলিশের তদন্ত, অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তি ও পরিবারের বক্তব্যে উঠে এসেছে হত্যার পেছনের জটিল ও মর্মান্তিক বর্ননা।
২০১৬ সালে সৌরভ রাজপুত ও মুসকান রাস্তোগির প্রেমের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের সম্পর্ক। পরবর্তীতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও পারিবারিক মতবিরোধের কারণে সৌরভ তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাড়ি নেন। ২০১৯ সালে কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেও মুসকানের সঙ্গে তার বন্ধু সাহিল শুক্লার অবৈধ সম্পর্ক প্রকাশ পায়। এই ঘটনায় দম্পতির সম্পর্কে চিড় ধরে, কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সৌরভ বিচ্ছেদ এড়াতে ২০২৩ সালে পুনরায় মার্চেন্ট নেভির চাকরিতে (লন্ডন) ফিরে যান।

২০২৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সৌরভ মিরাটে ফিরলে মুসকান ও সাহিল তাকে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে। পুলিশের তথ্যমতে, গত নভেম্বর থেকেই মুসকান এই হত্যা পরিকল্পনা করছিল। সে মুরগি কাটার অজুহাতে বড় ছুরি কেনে এবং মানসিক অসুস্থতার ভান করে চিকিৎসকের কাছ থেকে ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ করে। এছাড়া, ইন্টারনেট থেকে জেনে অতিরিক্ত ওষুধ কিনে রাখে। সৌরভকে অচেতন করার জন্য তার খাবারে বারবার ওষুধ মেশানোর চেষ্টা চালায়, কিন্তু প্রথমদিকে সফল হয়নি।
৪ মার্চ রাতে মুসকান সৌরভের খাবারে উচ্চমাত্রার ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে অচেতন করে। এরপর সাহিলের সাহায্যে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর লাশটি ১৫ টুকরো করে একটি ধাতব ড্রামে ভরে সিমেন্ট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশের কাছে মুসকান স্বীকার করে, “তাকে শেষ করতে পারলেই মুক্তি মিলবে” — এই মানসিকতায় তারা এই বিকট পদ্ধতি বেছে নেয়।

হত্যার পর অভিযুক্তরা সৌরভের মোবাইল ফোন নিয়ে হিমাচলের মানালি যায় এবং তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে ছবি পোস্ট করে। উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে বোঝানো যে সৌরভ সুস্থ আছে এবং লন্ডনে ফিরে গেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ফোনে যোগাযোগ না হওয়ায় সৌরভের পরিবার পুলিশে অভিযোগ করে। ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে পুলিশ মুসকান ও সাহিলকে আটক করে। জেরার মুখে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে।
অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, মিরাটের একটি ভাড়া বাড়ির ছাদে সিমেন্ট-বন্দী ড্রাম থেকে সৌরভের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। দেহের অবস্থা এমনই বিকৃত ছিল যে মর্গে ড্রিল মেশিনের সাহায্যে টুকরোগুলো বের করতে হয়। ময়নাতদন্তে শ্বাসরোধ ও রক্তক্ষরণকে মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা হয়।

এই মর্মান্তিক ঘটনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অভিযুক্ত স্ত্রী মুসকানের নিজের বাবা-মায়ের অবস্থান। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “মুসকানের ফাঁসি হোক। সে আমাদের মেয়ে হলেও, সৌরভ আমাদের ছেলের মতো ছিল।” মুসকানের মা কবিতা রাস্তোগি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “সে ফোন করে বলেছিল, ‘মা, আমরা সৌরভকে মেরে ফেলেছি”। সৌরভ তাকে ভালোবেসে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ছেড়েছিল, আর এটাই তাঁর প্রতিদান?”
এই হত্যা মামলায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে:
- -মুসকান হত্যার জন্য সাহিলকে মাদকাসক্ততার সুযোগে ব্যবহার করে। সাহিল মূল পরিকল্পনাকারী নয়।
- – দেহ লুকানোর জন্য মুসকান বিভিন্ন জায়গায় “পূজার বর্জ্য” ফেলার স্থান খুঁজেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়।
- – সৌরভের লন্ডন থেকে ফেরার পর মুসকান তাকে ওষুধ মেশানো অ্যালকোহল দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সৌরভ সেগুলো এড়িয়ে যান।
বর্তমানে মুসকান ও সাহিল জেলে রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০২ (হত্যা), ২০১ (প্রমাণ ধ্বংস) ও ১২০বি (ষড়যন্ত্র) অনুযায়ী মামলা চলছে। সৌরভের পরিবার ও মুসকানের বাবা-মা উভয়ই দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এই মামলা শুধু একটি হত্যাকাণ্ডই নয়, বরং স্বামী স্ত্রীয়ের পবিত্র সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা ও পৈশাচিক পরিকল্পনার এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এই হত্যাকাণ্ড সমাজে নৈতিকতার প্রশ্ন ও পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতার বার্তা দেয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সচেতনতা জরুরি বলে মনে করছেন সমাজকর্মীরা।