
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রাক্তন ডেপুটি স্পিকার ও বর্তমান বিজেপি নেত্রী সোনালী গুহ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তোলেন। একসময় মমতার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সোনালী, তবে বর্তমানে তিনি বিজেপির সদস্য। শনিবার এক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নানুরের এক ঘটনায় মমতা ও সিপিএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভূমিকা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন।
সোনালী গুহের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দশকে নানুরে সিপিএম কর্মীদের বোমাবাজির ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন বিরোধী দলনেতা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন ব্যবহার করে মমতা সোনালীকে যোগাযোগ করেন। সোনালী দাবি করেন, মমতা তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “সোনালী, বুদ্ধ ভট্টাচার্যকে ছাড়বি না!” এই কথা শুনে তিনি বিধানসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে সরাসরি প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে যান। তিনি স্মৃতি রোমন্থন করে সোনালী গুহু বলেন, “আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গলা টিপতে গিয়েছিলাম।”

সোনালীর মতে, তিনি বুদ্ধদেবকে সম্বোধন করতেন “এই বুদ্ধ” বলে, কিন্তু বুদ্ধদেব তাঁকে সর্বদা সম্মানসূচক “আপনি” বলেই সম্বোধন করতেন। নানুরের ঘটনায় সোনালী বুদ্ধদেবকে বলেন, “আপনার কমরেডরা বোমা মারছেন, আমাদের নেত্রী প্রবেশ করতে পারছেন না!”
সোনালীর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তিনি বুদ্ধদেবের দিকে রেগে এগিয়ে গিয়ে “গলা টিপে ধরার” ভঙ্গি করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কোনো রকম উত্তপ্ত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্তভাবে বলেছিলেন, “দাঁড়ান সোনালী, শুনুন…”। এমনকি, সোনালীকে “আপনি” সম্বোধন করে তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেন। এই ঘটনায় বুদ্ধদেবের সংযম ও মার্জিত আচরণ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
এরপর বুদ্ধদেব তাঁর সচিব ভাস্কর লায়েককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন এবং সোনালীকে আশ্বস্ত করেন, “আপনার নেত্রীকে বলুন, ১০ মিনিটের মধ্যে বোমাবাজি বন্ধ হবে।” পরদিন সংবাদমাধ্যমে এই বিবৃতি শিরোনাম হয়।
সোনালী আরও জানান, মমতা ওই সময় বিরোধী দলনেতা পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর আস্থা রাখতেন না। তাঁর মতে, পঙ্কজ ও বুদ্ধদেবের মধ্যে গোপন সমঝোতা ছিল। এনিয়ে মমতার ক্ষোভের কথাও উল্লেখ করেন সোনালী। অন্যদিকে, সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষ সোনালীর বক্তব্যকে “নাটকীয়তা” আখ্যা দিয়ে বলেন, দলবদলের পরই এমন অভিযোগ আসে। মমতা ও তাঁর দলের নেতারা কতটা নিম্ন মানের রাজনীতি করেন, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সোনালী গুহের এই স্বীকারোক্তি আজও প্রমাণ করে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শুধু সিপিএমের নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনীতির গরিমা রক্ষার এক মহান পথিকৃৎ। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও তাঁর ধৈর্য ও নীতিনিষ্ঠা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, “রাজনীতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের ময়দান নয়, বরং জনসেবার মাধ্যম”—বুদ্ধদেবের এই দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রমাণ করেছিলেন, আদর্শ আর মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে রাজনীতি হতে পারে মহৎ পেশা। তাঁর জীবনী শুধু বামপন্থী কর্মীদের জন্যই নয়, সর্বস্তরের রাজনীতিকদের জন্য এক প্রেরণাদায়ী ব্যক্তি। বাংলার রাজনীতিতে যখন কুরুচি ও হিংসার ছায়া ঘনীভূত, ঠিক তখনই বুদ্ধদেবের উত্তরাধিকার আমাদের মনে করিয়ে দেয়—“রাজনীতি মানেই যে শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, তা হতে পারে সমাজ গঠনের হাতিয়ার।”