
শীর্ষ মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ক্লাউড কম্পিউটিং সেবার মাধ্যমে ইসরায়েলকে গাজা ও লেবাননে দ্রুততার সাথে নিরীহ অসামরিক ব্যক্তিদের আক্রমণ করতে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, গুগল, ওরাকল, সিসকো এবং প্যালান্টির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহকৃত প্রযুক্তি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য শনাক্তকরণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এর ফলে গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজা ও লেবাননে হামলার সংখ্যা ও নিহতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাইক্রোসফটের ‘অ্যাজুর’ ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ফোনকল, টেক্সট, অডিও বার্তা এবং গণনিরীক্ষণের মাধ্যমে সংগৃহীত বিপুল ডেটা বিশ্লেষণ করা হয়। এই ডেটা ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ এআই-চালিত টার্গেটিং সিস্টেমের সাথে সমন্বয় করে হামলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাজুরের সাহায্যে ৫০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্টে দুজনের কথোপকথন বা নির্দেশনা খুঁজে বের করে তা জিপিএস ডেটার সাথে মিলিয়ে সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব।

এছাড়া, প্যালান্টির ডেটা এনালিটিক্স সফটওয়্যার, সিসকো-ওরাকলের নেটওয়ার্কিং অবকাঠামো এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেসের (এডব্লিউএস) ক্লাউড সেবা সামরিক অপারেশনে ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যামাজন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও রেড হ্যাট (আইবিএমের সহায়ক প্রতিষ্ঠান) জানিয়েছে, তাদের গ্লোবাল ক্লায়েন্টরা আইন ও নিয়মকানুন মেনেই সেবা পাচ্ছেন।
এআই মডেলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণস্বরূপ, ওপেনএআই-এর ‘হুইস্পার’ মডেলের মাধ্যমে আরবি থেকে হিব্রু অনুবাদে ভুলের ঘটনা ঘটেছে। এক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তার বর্ণনায়, আরবি শব্দ “গ্রিপ” (রকেট লঞ্চারের অংশ) এবং “পেমেন্ট” শব্দের অনুবাদ গুলিয়ে ফেলায় লক্ষ্য তালিকায় ভুল ব্যক্তির নাম যুক্ত হতে পারে। এমনকি গাজার এক স্কুলের ১,০০০ শিক্ষার্থীর পরীক্ষার তালিকা ‘সন্দেহভাজন মিলিট্যান্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে শনাক্ত করা হয়।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করে, প্রতিটি টার্গেট শনাক্তের আগে আরবি ভাষায় দক্ষ কর্মকর্তারা ডেটা যাচাই করেন। তবে এআই-নির্ভর সিস্টেমে মানবীয় ত্রুটির সম্ভাবনা থেকেই যায়। নেভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের অধ্যাপক জোশুয়া ক্রোলের মতে, “এআই মডেল যে তথ্য দিচ্ছে, তা কি আদৌ বাস্তব? নাকি মডেল নিজে থেকে কিছু তৈরি করছে? এ নিয়ে সন্দেহ থাকবেই।”
গত বছর ওপেনএআই এবং গুগল তাদের এআই ব্যবহারের নীতিমালা পরিবর্তন করে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনীর সাথে কাজের পথ খুলে দেয়। গুগল জানিয়েছে, তারা “দায়িত্বশীল এআই উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। অন্যদিকে, প্যালান্টির সিইও অ্যালেক্স কার্প এক বিবৃতিতে দাবি করেছেন, তাদের প্রযুক্তি “পশ্চিমা গণতন্ত্রের শক্তি বৃদ্ধি করছে”।

প্রযুক্তির এই ব্যবহারের নীতিগত দিক ছাড়াও মানবিক সংকট তীব্র হচ্ছে। লেবাননের দক্ষিণে গত নভেম্বরে একটি গাড়িতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় মাহমুদ আদনান চৌরের তিন কন্যাসহ পাঁচজন নিহত হন। চৌর জানান, হামলার কোনো স্পষ্ট কারণ তিনি খুঁজে পাননি: “কেন আমার সন্তানদের গাড়িটিকেই বেছে নেওয়া হলো? তাদের হাসিই কি অপরাধ ছিল?”

এই প্রযুক্তিগত সহায়তা যুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করলেও এর নৈতিকতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক চলছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এআই-এর ভুল সিদ্ধান্ত মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, আর প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।