
কলকাতা শহর যেন আবারও ভয়াবহ আগুনের আতঙ্কে কাঁপল। বড়বাজারের ভয়ংকর মেছুয়াবাজার কাণ্ডের স্মৃতি যেখানে এখনো দগদগে, ঠিক তার পরপরই শহরের আরেক প্রান্তে, দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত এলাকায় — শরৎ বোস রোডে — দেখা গেল তেমনই এক বিভীষিকা। ৪৪ নম্বর শরৎ বোস রোডে অবস্থিত একটি পাঁচতলা হোটেলে সোমবার গভীর রাতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যার ধোঁয়া ও আগুনের শিখায় রাতজাগা শহর বিস্মিত ও শঙ্কিত।
রাত প্রায় ১টা নাগাদ হঠাৎ করেই হোটেলের উপরের তলায়, যেখানে একটি কনফারেন্স রুম রয়েছে, সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা যায়। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় হোটেলে প্রায় ৫০ জনের বেশি অতিথি ছিলেন বলে সূত্রের খবর। পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে ওঠার আগেই হোটেল কর্তৃপক্ষ তৎপরতার সঙ্গে সমস্ত অতিথিকে বের করে আনেন।
দমকলকে খবর দেওয়া মাত্রই প্রথমে দুটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় পরে আরও তিনটি ইঞ্জিন আনা হয়। দমকলের মোট পাঁচটি ইঞ্জিন প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। স্থানীয় প্রশাসন ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। ভবনের জানালার কাচ ভেঙে দ্রুত ধোঁয়া বাইরে বের করার ব্যবস্থা করা হয়।
অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ধরা হচ্ছে শর্ট সার্কিট। কনফারেন্স রুমে লাগানো একটি এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট থেকেই সম্ভবত এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। যদিও, ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত শুরু হয়েছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। তদন্ত চলাকালীন হোটেল কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে।
ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে — কীভাবে একটি এত বড় হোটেলে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা না-থাকায় পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠল? স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, “হোটেলের কনফারেন্স রুমে নিয়মিত বড় সভা, অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু সেখানে আগুন লাগার মতো পরিস্থিতিতে মোকাবিলার মতো কোনও আগাম প্রস্তুতি চোখে পড়েনি।”
কলকাতা ফায়ার অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সার্ভিসেস-এর এক আধিকারিক জানিয়েছেন, হোটেলটির অগ্নি-নিরাপত্তা অনুমোদন কাগজপত্র খতিয়ে দেখা হবে। যদি কোনওরকম গাফিলতি পাওয়া যায়, তবে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শহরে একের পর এক হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে। বড়বাজারের মেছুয়াবাজারে আগুনে ১৪ জনের মৃত্যু, তার রেশ না কাটতেই এবার শরৎ বোস রোডের হোটেল। শহরের অভিজাত এবং বাণিজ্যিক দুই অঞ্চলেই এই ঘটনা একই রকম উদ্বেগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দমকল মন্ত্রী জানিয়েছেন, শহরের সমস্ত ছোট-বড় হোটেল, অতিথিশালা ও হোস্টেলগুলিতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং সার্ভে ফের চালানো হবে। প্রতিটি স্থানে থাকবে নিয়মিত পরিদর্শন এবং যেখানে ত্রুটি ধরা পড়বে, সেখানে জরিমানার পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিল পর্যন্ত হতে পারে।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট জানিয়েছেন, “আমাদের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলেই কোনও প্রাণহানি হয়নি। আমরা প্রশাসনের তদন্তে সহযোগিতা করছি এবং ভবিষ্যতে আরও উন্নত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকেই মনোযোগ দেব।”
হোটেলে উপস্থিত এক অতিথি বলেন, “ধোঁয়া টের পাওয়ার পর প্রথমে আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু কর্মীরা দ্রুত ব্যবস্থা নেয়, তাই রক্ষা পেয়েছি। এমন ঘটনা দ্বিতীয়বার চাই না।”
আরেকজন জানান, “হোটেলের ঘরে আগুন-সংক্রান্ত সতর্কতা বোঝায় এমন কোনও নির্দেশিকা ছিল না। যদি আগুন রাতে ঘুমের সময়ে ছড়াত, তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না।”
এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে শহরবাসী। প্রশাসনের কাছে এখন প্রশ্ন — শিক্ষা নেবে তো শহর? নাকি হোটেলগুলোতে আগুন আরও বারবার ফিরে আসবে?