
বেলজিয়ামের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই-এর অনুরোধে মেহুল চোকসিকে শনিবার গ্রেপ্তার করেছে। সূত্রমতে, দেশটিতে তার অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর এই অভিযান চালানো হয়। বর্তমানে তাকে ভারত ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। তবে চোকসির আইনজীবী দল ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন, তারা স্বাস্থ্যগত জটিলতা এবং আইনি লঙ্ঘনের দাবি তুলে প্রত্যর্পণ বিরোধী লড়াই শুরু করবেন। চোকসির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে তিনি রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ভারতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা নেই।
২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের (পিএনবি) কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেহুল চোকসি ও তার ভাতিজা নীরব মোদি জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির ১৩,৮৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এই স্কিমে তারা জাল “লেটার অফ আন্ডারটেকিং” (এলওইউ) তৈরি করে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতেন, যা পরবর্তীতে ফেরত দেওয়া হয়নি। পিএনবি-র সরাসরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬,০৯৭ কোটি টাকায়। তদন্তে এগিয়ে এসে প্রবর্তন অধিদপ্তর (ইডি) চোকসির গীতাঞ্জলি গ্রুপের ১৩৬টি স্থানে তল্লাশি চালিয়ে ৫৯৭ কোটি টাকার গয়না ও নগদ অর্থ উদ্ধার করে। এছাড়া, দেশ-বিদেশে তার ১,৯৬৮ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করা হয়। মোট ২,৫৬৫ কোটি টাকার সম্পদ এই মামলার সাথে জড়িত বলে নথিভুক্ত হয়েছে।
২০১৮ সালের ২রা জানুয়ারি ভারত ছাড়ার পর চোকসি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পরে অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডার নাগরিকত্ব নেন। ২০২১ সালের মে মাসে তাকে ডোমিনিকায় আটক করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, তিনি কিউবার উদ্দেশ্যে পালাতে চাইছিলেন। তবে তার আইনজীবীরা দাবি করেছিলেন, তাকে জোরপূর্বক অ্যান্টিগুয়া থেকে অপহরণ করা হয়েছে। ডোমিনিকার আদালত তাকে ভারতে না পাঠিয়ে অ্যান্টিগুয়ায় ফেরত পাঠায়। ২০২৪ সালে চোকসি ও তার স্ত্রী প্রীতি বেলজিয়ামে স্থানান্তরিত হন। প্রীতির বেলজিয়াম নাগরিকত্বের সুবাদে তারা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়েছিলেন। সম্প্রতি বেলজিয়ামে চিকিৎসার নামে অবস্থান করছিলেন চোকসি।
চোকসির প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, তিনি অ্যান্টিগুয়ার নাগরিক, এবং বেলজিয়ামে তার স্ত্রীর নাগরিকত্বের কারণে স্থানীয় আইনে তার কিছু সুবিধা থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, তার আইনজীবীরা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন। এছাড়া, ২০২৩ সালের মার্চে ইন্টারপোল চোকসির বিরুদ্ধে জারি করা রেড নোটিশ প্রত্যাহার করে নেয়, যা তাকে আন্তর্জাতিক স্তরে খোঁজার প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে অবশ্য বেলজিয়ামের সাথে বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তির ভিত্তিতে জোরালো কেস তৈরি করা হচ্ছে।
চোকসির ভাইপো নীরব মোদি ২০১৯ সাল থেকে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের কারাগারে আটক আছেন। ব্রিটিশ আদালত তাকে ভারত প্রত্যর্পণের অনুমতি দিলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কায় এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। চোকসির ক্ষেত্রেও একই রকম দীর্ঘসূত্রতা দেখা যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। উভয় ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে ভারতের কারাগারের পরিবেশ ও বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।

জালিয়াতির অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা চোকসির সাম্রাজ্যের বেশিরভাগই এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ইডি-র তদন্তে তার গীতাঞ্জলি গ্রুপের শো-রুম, হীরার গয়না, বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, এবং মুম্বাই, দিল্লি, দুবাইতে থাকা বহু কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তবুও, ধারণা করা হয়, চোকসির ব্যক্তিগত সম্পদের একটি বড় অংশ এখনও বিদেশেই রয়ে গেছে।
চোকসির স্ত্রী প্রীতি চোকসির বেলজিয়াম নাগরিকত্ব এই মামলায় একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দম্পতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তবে বেলজিয়ামে গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন সেই সম্ভাবনা অনিশ্চিত। অ্যান্টিগুয়ার মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, চোকসি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ও ইউরোপের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যমে তার সম্পদ ও আইনি সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।
মেহুল চোকসির গ্রেপ্তার ভারতের জন্য একটি বড় সাফল্য হলেও, তাকে দেশে ফেরত আনতে এখনও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। ইউরোপের আদালতগুলো মানবাধিকার ও চিকিৎসার অজুহাতে প্রায়শই প্রত্যর্পণে বিলম্ব করে থাকে। নীরব মোদির মামলা তার জলন্ত উদাহরণ। তবে, বেলজিয়ামের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং সিবিআই-এর প্রমাণাদি শক্তিশালী হলে, এই প্রথম কোনো বড় মাপের অর্থপাচারকারীকে হয়তো ভারতের আদালতে মুখোমুখি হতে দেখা যাবে। চোকসির মামলা তাই শুধু একটি আইনি লড়াই নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের আইনী শক্তির পরীক্ষাও বটে।