মুসলিম নির্যাতনের নীরব অধ্যায়

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

image-3

~ঝুমুর রায়

ঝুমুর রায়

আজ থেকে বছর ত্রিশ আগেও ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল।কিন্তু আজ নেই কেন? দেশে যখন মুসলিমরা শিক্ষিত হতে শুরু করল, বুঝতে শুরু করল, তখন তাদের বর্ণবাদমুক্ত আচার-আচরণ ও নিয়মনীতি দেশের তথাকথিত নিচু হিন্দুদের ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ ভাঙিয়ে দিল। জেগে উঠল তথাকথিত নিচু হিন্দুরা। তারা বুঝতে পারল যে, এতদিন ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদেরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে অস্পৃশ্য করে রেখেছে। নিচু জাত হিসাবে তাদের ঠাঁই হয়েছে সমাজর প্রান্তিক শ্রেণিতে। তখন থেকেই বর্ণহিন্দুরা মুসলিম বিদ্বেষমূলক আচরণ প্রকাশ করতে শুরু করল। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা নিজেদের বানানো তথাকথিত বিশাল সংখ্যাক নিচু হিন্দুদের শোষণ করতে লাগল।

প্রায় এই সময় থেকেই একরকম তেড়েফুঁড়ে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিল হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। যদিও হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বহু পুরনো। বাবাসাহেব ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের আমল থেকেই হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল।তাই আম্বেদকর লিখে গেছেন, “কোনও ভাবেই ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করতে দেওয়া হবে না। হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করা হলে ভারতীয় জনগণের অবস্থা হবে ভয়াবহ।”

মোহম্মদপুর লোডা (মুজফ্ফরনগর, উত্তরপ্রদেশ) গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের মেয়ে ফরমানি নাজ। ভারতে অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। সেখানে হিন্দু-মুসলিমে বিশেষ ফারাক নেই। নাজের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। বিয়ের পর স্বাভাবিক নিয়মেই সন্তানের জন্ম দেয় ফরমানি। কিন্তু তারপর থেকেই সমস্যা সৃষ্টি হয়। তার স্বামী ফরমানিকে অসুস্থ সন্তান সহ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য এক মহিলার সঙ্গে সংসার করতে থাকে। এদিকে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয় ফরমানি নাজ। বাবার সংসারে নিত্য অভাব। অভাবের তাড়নায় তাই সে-ও ভাইদের মতো দিনমজুরের কাজে যুক্ত হয়ে যায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আধপেটা খেয়ে দিন পার হয়ে যাচ্ছিল ফরমানি নাজের। কিন্তু স্বামী পরিত্যক্তা, দিনমজুর সেই ফরমানি নাজই সেলিব্রেটি হয়েছে এখন!

কিছু মানুষ আছেন জন্মগতভাবেই যাঁরা বিশেষ মেধার অধিকারী হন। ফরমানিও তেমনই ব্যতিক্রমী মেধার অধিকারীনি। তার সুরেলা কন্ঠ মুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাকে। বেশ চমৎকার গানের গলা ফরমানির। তার ভাই একবার ফরমানি নাজের একটি ভজন ইউটিউবে আপলোড করে দেয়। যা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে পড়ে। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় ফরমানির। সেই যাত্রাপথ ধরেই ফরমানি নাজ আজ একজন সেলিব্রিটি ।

এরপর ফরমানির মিষ্টি কন্ঠে গাওয়া ভজন একের পর এক আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই ভাইরাল হতে থাকে। তার ভজনগুলি ছিল মূলত শিবকে কেন্দ্র করে। এই মুহূর্তে ফরমানি নাজের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৩৮ লাখ ছড়িয়েছে। ইউটিউবে তার গাওয়া “হর হর শম্ভু” ভজনটি সাড়ে ৭৮ লাখের বেশি মানুষ দেখে ফেলেছেন।

আমাদের দেশের গদি মিডিয়াগুলো সংখ্যালঘুদের উত্থান তেমন একটা পছন্দ করে না। তার ওপর একজন মুসলিম মেয়ে হিন্দুধর্মের দেবতার ভজন গেয়ে ওপরে উঠে যাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। ফলে হিন্দুত্ববাদীরা ফরমান জারি করল ফরমানি নাজের ভজন গাওয়া চলবে না। তারা প্রশ্ন তুলেছে, একজন মুসলিম হয়ে ফরমানি কেন শিবের ভজন গাইবে?

এমন প্রশ্ন কিন্তু মহাম্মদ রফি বা আজীজের সময়ে তোলা হয়নি। নানক বা লালন শাহের আমলেও না। শাকিল যখন ভজন লিখেছেন, তখনও এমন প্রশ্ন কোনও হিন্দুত্বাদী তোলেনি। কাজী নজরুল যে এত শ্যামা সংগীত রচনা করলেন, তখনও কেউ এমন প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে কেন এখন এমন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে? যখন ফরমানি নাজের সন্তান অসুস্থ, অর্থের অভাবে চিকিৎসা চালানো দায় হয়ে পড়ে, দুবেলা খাবার জোটে না ঠিকমতো, তখন কিন্তু এই হিন্দুত্ববাদীরা কোনও প্রশ্ন তোলেনি। এমন ঘটনা শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে ঘটে, তা কিন্তু নয়।তথাকথিত নিচু হিন্দুদের ক্ষেত্রেও এমনটা হরহামেশাই ঘটে। মিডিয়া, সংস্কৃতি, মন্দির, আদালত, সরকার—সবই যেন হিন্দুত্ববাদীদের দখলে!

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর