“যে জমি একদিন দান হয়েছিল মানুষের কল্যাণে, তা আজ রাজনীতির শিকার হয়ে পরিণত হয়েছে বিভাজনের অস্ত্রে।”
ভারতের মতো বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় দাতব্য সম্পত্তি, বিশেষ করে মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি, এক সময় সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু আজ এই ওয়াকফই পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং প্রশাসনিক অনিয়মের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশ্ন উঠছে — ধর্মীয় বিশ্বাসে নিবেদিত দান কি রাজনীতির হাতিয়ার হতে পারে?

ওয়াকফ হল ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘আল্লাহর নামে’ দানকৃত সম্পত্তি, যা চিরকালীনভাবে সমাজসেবার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ার কথা। ভারতে ওয়াকফ বোর্ড নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এই সম্পত্তিগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াকফ বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই ইস্যুকে ঘিরে নিজেদের মতাদর্শিক উদ্দেশ্য সাধনে নেমে পড়েছে।
বিজেপির অবস্থান এই বিষয়ে একেবারেই স্পষ্ট — তারা ওয়াকফ ব্যবস্থাকে মুসলিম তোষণের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে। ‘ওয়াকফ রাজ’ বা ‘জমি জেহাদ’-এর মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তারা দাবি করছে, এই সম্পত্তিগুলি যথাযথ দলিলপত্র ছাড়াই দখল করা হয়েছে, যাতে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বাস্তবে যদিও অনেকক্ষেত্রে এই বিতর্ক আইনগত এবং তথ্যগত বিষয়, তবুও বিজেপি এটিকে এক বিশাল ধর্মীয় সংকটে রূপান্তর করতে সচেষ্ট। এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে।

তবে শুধু বিজেপিই নয়, তৃণমূল কংগ্রেসও এই প্রশ্নে অনেকটাই দ্বিচারিতা প্রদর্শন করছে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার দাবিতে বারবার তৃণমূল সরকার সরব হলেও, বাস্তবে ওয়াকফ বোর্ডের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। বরং ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হওয়া, দখলদারদের মদত পাওয়া এবং রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একদিকে সংখ্যালঘু সমর্থনের মোড়কে ভোটব্যাংক রক্ষা, অন্যদিকে প্রকৃত সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া — এই দ্বিমুখী নীতিই বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিফলিত।
বাংলার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এখানকার ওয়াকফ সম্পত্তির বেশিরভাগই বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনিক নজরদারির বাইরে থেকে গেছে। বহু মাদ্রাসা বা দরিদ্র মুসলিম পরিবার এই সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনার ফলে তার সুফল তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। অথচ এই ইস্যুতে তৃণমূল সরকার নীরব, এবং বিজেপি তা ব্যবহার করছে নিজেদের ধর্মীয় রাজনীতির আগুনে ঘি ঢালার জন্য।
বড় চিত্রে দেখা যায়, ভারতে ধর্মীয় রাজনীতি একটি বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে। গোরক্ষা থেকে লাভ জেহাদ এবং এখন ওয়াকফ বিতর্ক — প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে একটি সাম্প্রদায়িক বার্তা প্রচার করা হচ্ছে। বিজেপি শাসনে এই প্রবণতা ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবির আড়ালে ধর্মীয় বিভাজন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই যেন মূল লক্ষ্য।

ওয়াকফ বিতর্ক নিছক একটি প্রশাসনিক বা আইনি প্রশ্ন নয় — এটি এখন একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অস্ত্র। যার ফলে সমাজে বিভেদ, বিদ্বেষ এবং অস্থিরতা বাড়ছে। অথচ এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে সেই সম্পত্তি, যা একদিন সমাজকল্যাণের জন্য উৎসর্গীকৃত হয়েছিল। আজ সেটিই পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্রে, যার ফল ভোগ করছে সাধারণ মুসলিম নাগরিকরা।
এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন, ধর্মকে রাজনীতির হাত থেকে মুক্ত রাখা এবং ওয়াকফ ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও আইনসম্মত পথে পরিচালনা করা। প্রশাসনের উচিত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তদন্ত ও সংস্কার প্রক্রিয়া চালানো, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে রাজনীতিকে বিভাজনের পথে না ঠেলা।
এই বিতর্ক কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের সমস্যা নয় — এটি ভারতের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাংবিধানিক আদর্শের সামনে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। আজ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া এবং সঠিক অবস্থান নেওয়া জরুরি — নইলে ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হয়ে উঠবে।