পার্বতীপুরে ১৪১ বছর পরে লাগাতার যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ
বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম জোনের সর্ববৃহৎ রেল জংশন স্টেশন পার্বতীপুর। এ স্টেশনটি চালু হওয়ার দীর্ঘ ১৪১ বছরের মাথায় এই প্রথম বারের মতো লাগাতার ১০দিন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণার ৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে আজ সোমবার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুরে ট্রেন চলাচল করেছে। সেসময় যাত্রীরা ছিলেন বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা নেওয়া করা হতো যাত্রীবাহী ট্রেনেই। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শাটল ট্রেনও চলাচল করেছে বলে জানা যায়।
যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় পুরো স্টেশনের ৫টি প্লাটফর্মে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। প্লাটফর্মগুলাতে ভবঘুরে, মস্তিষ্ক বিকৃত, বিকলাঙ্গ মানুষ ছাড়া কোনও যাত্রী বা সাধারণ মানুষের সাক্ষাত মেলেনি গত ৫দিনে। যারা স্টেশনে রয়েছেন তাদেরকে চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীনের ছবির ভাষায় বলা যায় এই মানুষ ট্রেন তৈরি করেছে, সেই ট্রেনের গন্তব্যস্থলও আছে। কিন্তু যে মানুষেরা ট্রেন তৈরি করেছিলো তাদের উত্তরসুরীদের কোনও গন্তব্যস্থল নেই।
১৮৭৬ সালে স্থাপিত হয় পার্বতীপুর স্টেশন। সেসময় কলকাতা থেকে পার্বতীপুর হয়ে সরাসরি শিলিগুড়ি যাওয়া যেত। পরবর্তীতে ভারতের কোচবিহারের সঙ্গে রেলসংযোগ স্থাপনের জন্য পার্বতীপুরকে বেছে নেয়া হয়। নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের আওতায় মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ১৮৭৯ সালে পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত এবং বুড়িমারী-চেংরাবান্ধা রেল স্থাপনের মাধ্যমে পার্বতীপুর স্টেশন থেকে পার্বতীপুর জংশনে রূপান্তরিত হয়।
এর পর ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত পার্বতীপুর রেলস্টেশনের নাম বৃটিশ সাম্রাজ্যব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ পার্বতীপুর হয়ে যাতায়াত করতো এসময়ে। ব্যবসা, বাণিজ্যের জন্য নদী ও সমুদ্র পথের বাইরে নতুন রুট রেলপথে পরিচিত নাম হয়ে দাঁড়ায় পার্বতীপুর। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ ভাগ হয়। এর আগে আজকের বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল পূর্ববঙ্গ। দেশ ভাগের পর এর নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান (ইস্ট পাকিস্তান)। তারপর ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের শাসন, শোষন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিরা লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম করে এসেছে তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
১৯৭১ সালে এই মহান নেতার স্বাধীনতা ঘোষণার পর দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালিরা যুদ্ধ করেছে মাঠে ময়দানে, সশস্ত্র পন্থায়, জনযুদ্ধে। এই দীর্ঘ সময়েও পার্বতীপুর রেল স্টেশন বন্ধ থাকেনি। তবে সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল না করলেও সৈয়দপুর ও রংপুর ক্যান্টনমেন্টের সৈন্য ও অস্ত্র গোলাবারুদ পরিবহনে এ স্টেশন ব্যবহৃত হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে দূর পাল্লার যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করলেও অবাঙালি বিহারি আর পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের কারণে পার্বতীপুর রেল স্টেশনের যাত্রীবাহী ট্রেনে বাঙালি যাত্রীরা চরমভাবে নিগৃহীত হয়। এর ফলে দ্রুত যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতার পরে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের শেষের দিকে ১৫ দলীয় ও ৭ দলীয় জোটের ডাকে এবং শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সমর্থনে ১২ ঘণ্টা, ২৪ ঘন্টা, ৩৬ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা এবং সর্বশেষ ৭২ ঘণ্টা ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এর পর ১৯৯৬ সালে বেগম খালেদা জিয়া সরকারের সময়ে তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ ও বাম দলীয় জোটের আহবানে সকাল সন্ধ্যা রাজপথ ও রেলপথ সর্বাত্মক অবরোধকালে পার্বতীপুর রেলস্টেশন পুরোপুরি বন্ধ থাকে ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত।
পার্বতীপুর রেলস্টেশন মাস্টার অফিস সূত্রে বলা হয়েছে, পঞ্চগড়-ঢাকার মধ্যে পার্বতীপুর হয়ে যেসব আন্তঃনগর যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে ৭৯৩/৭৯৪ ডাউন পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, ৭৫৭আপ / ৭৫৮ ডাউন দ্রুতযান এক্সপ্রেস, ৭০৫ আপ/ ৭০৬ ডাউন একতা এক্সপ্রেস ট্রেন। চিলাহাটিÑঢাকার মধ্যে বন্ধ রয়েছে আন্তঃনগর ৭৬৫ আপ/ ৭৬৬ ডাউন নিলসাগর এক্সপ্রেস ও কুড়িগ্রাম- পার্বতীপুর-ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী ৭৯৭ আপ/ ৭৯৮ ডাউন কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেন।
চিলাহাটি থেকে ২ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন পার্বতীপুর হয়ে খুলনা রেলস্টেশনের মধ্যে যাতায়াত করে থাকে। গত ৫দিন ধরে এ ২জোড়া ট্রেন বন্ধ রয়েছে। ট্রেনগুলো হচ্ছে ৭২৭ আপ /৭২৮ ডাউন রুপসা এক্সপ্রেস ও ৭৪৭ আপ / ৭৪৮ ডাউন সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন। এছাড়াও চিলাহাটি- পার্বতীপুর –রাজশাহীর মধ্যে বন্ধ রয়েছে আন্তঃনগর ৭৩৩ আপ / ৭৩৪ ডাউন তিতুমীর ও ৭৩১ আপ /৭৩২ ডাউন বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ট্রেন। দিনাজপুর থেকে পার্বতীপুর- রংপুর-কাউনিয়া- গাইবান্ধা- বগুড়া ও সান্তাহার রেলস্টেশনের মধ্যে চলাচলকারী একমাত্র আন্তঃনগর ট্রেন দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস এসময়ের মধ্যে বন্ধ রয়েছে।
পার্বতীপুর রেলস্টেশন হয়ে অথবা পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া সাকুল্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সংখ্যা বর্তমানে ৩৩টি। আন্তঃনগর ট্রেনের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ মেইল, ডেমু ও লোকাল ট্রেন রয়েছে। বন্ধ হওয়া ট্রেন গুলোর মধ্যে আছে ৭ আপ / ৮ ডাউন উত্তবঙ্গ মেইল ট্রেন, ২৩ আপ /২৪ ডাউন চিলাহাটি-পার্বতীপুর-খুলনা রুটে চলে রকেট মেইল ট্রেন। পার্বতীপুর স্টেশন থেকে রাজশাহী স্টেশনের মধ্যে চলাচলকারী ৩১ আপ/ ৩২ ডাউন উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন। পার্বতীপুর-রমনাবাজার (চিলমারী) রেলস্টেশনের মধ্যে চলাচলকারী একমাত্র ট্রেন রমনাবাজার এক্সপ্রেস। পার্বতীপুর-লালমনিরহাট ও পার্বতীপুর-বুড়িমারী স্টেশনের মধ্যে বন্ধ থাকা ২জোড়া ট্রেনের নাম ৪৬১ আপ/ ৪৬২ ডাউন এলআর এবং ৬৩ আপ/ ৬৪ ডাউন বুড়িমারী এক্সপ্রেস। বুড়িমারী-পার্বতীপুর ও দিনাজপুরের বিরল রেল স্টেশনের মধ্যে বন্ধ রয়েছে বুড়িমারী কমিউটার ট্রেন। পার্বতীপুর-লালমনিরহাটের মধ্যে ডেমু-১ ও পার্বতীপুর-পঞ্চগড়ের মধ্যে ডেমু-২ এ ট্রেন দুটিও বন্ধ আছে।
পার্বতীপুর রেলস্টেশন মাস্টার জিয়াউল আহসান জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক সারাদেশব্যাপী যাত্রীবাহী সকল ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে গত ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার থেকে পার্বতীপুর রেলস্টেশন হয়ে যাতায়াতকারী সকল যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ আছে। তবে খুলনা থেকে পার্বতীপুর, চট্টগ্রাম থেকে পার্বতীপুর এবং ভারতের রাধিকাপুর থেকে দিনাজপুরের বিরল রেলস্টেশন হয়ে পার্বতীপুরে জ্বালানি তেল বহনকারী ওয়াগনের চলাচল অব্যাহত আছে।
খুলনা ও রাধিকাপুর থেকে আসা এসব তেলবাহী ওয়াগনের গন্তব্যস্থল পার্বতীপুরের রেলহেড ওয়েল ডিপো। যাত্রীবাহী সকল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও চলতি বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষে বিভিন্ন স্থান থেকে পার্বতীপুর রেলহেড ওয়েল ডিপোতে ওয়াগনের মাধ্যমে তেল সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
-আবদুল কাদির, পার্বতীপর (দিনাজপুর), কালেরকণ্ঠ