ফিরে দেখা নোটবন্দির 6 বছর

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

demonetisation

~মুদাসসির নিয়া

গাণিতিক হিসেবে নোট বাতিলের বয়স ৬ বছর ছুঁই ছুঁই। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর এই কেরামতি দেখিয়েছিলেন ফেকুজি। গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,,, সন্ত্রাসবাদ খতম হবে, কালো টাকা আতুড়ঘরে আত্মহত্যা করবে ইত্যাদি প্রভৃতি। কিন্তু গত ৬ বছরে দেখা গেল, সেসব কিসসু হয়নি। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নোটবন্দিকে বলেছেন ব্যর্থ। কেউ বলেছেন অপরিকল্পিত পদক্ষেপ। কেউ বলেছেন অদূরদর্শিতা। কেউ বলেছেন অপরিণামদর্শী চিন্তাধারা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

কালো টাকা উদ্ধারের নামে নোটবন্দির এই নাটক এক্কেরে সুপার ফ্লপ হয়েছে। কিন্তু ১৩০ কোটির দেশে এমন দীর্ঘ নাটক মঞ্চস্থ করতে এবং নতুন নোট ছাপতে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আজ ২০০০ টাকার নোট ডোডোপাখি হয়ে উবে গেছে। কিন্তু সেই সুযোগে কতজন কালোটাকা সাদা করিয়ে নিয়েছে। কত লোক রুটি সেঁকে নিলো, আবার কত মানুসের চাটু জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। অন্য সব কোম্পানি মুখ থুবড়ে পড়লেও শাহী পুত্রং অ্যান্ড কোম্পানি ১৬ হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝখান থেকে নিজের জমানো টাকা তুলতে গিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে।

জিএসটি নিয়ে আজও অযুত নিযুত অভিযোগ। ব্যবসায়ীরা তেলে বেগুনে জ্বলছেন আর গেরুয়া বাহিনী লুচির মতে্া ফুলছেন, কারওবা আঙুল ফুলে কলাগাছ। দেশজুড়ে জিএসটি প্রত্যাহারের দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। সরকার বাহাদুর সে সবের থোড়াই কেয়ার করে। ওদের কানে তুলো, পিঠে বাঁধা কুলো। কিন্তু নমো সরকার সব জেনেও ভুল স্বীকার তো দূরে থাক, ছোটখাট ব্যবসায়ীদের সামান্য সহানুভূতিটুকুও দেখায়নি। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে সংবেদনশীলতার লেশমাত্র দেখা যায়নি, এতটাই অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। অথচ এরা মুখে বলে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। এই ফাঁপা স্লোগানের নবতম সংযোজন সবকা বিশ্বাস।

টাকা বদলের জন্য লাইন।

এমনিতেই এ দেশে রাজনীতির হাত জিরাফের গলার থেকেও লম্বা। গুরুপাপেও তাদের সচরাচর লঘুদণ্ড হয় না। ওদের সাত খুন মাফ। আদালত, বিচার ব্যবস্থা ওনাদের ক্ষেত্রে প্রহসনে পরিণত হয়। দুর্নীতির কোনো ইয়ত্তা নেই। রাজনীতির ছত্রছায়ায় থাকা বিল্লি থেকে দিল্লি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। মহামান্য নেতানেত্রীরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কিন্তু শাস্তি তো দূর অস্ত! ভুল নীতির মাশুলও এদেশের বিশ্বকর্মা, থুড়ি করিৎকর্মা নেতা-নেত্রীদের দিতে হয় না। নোটবন্দি করে কালো টাকাকে জব্দ করা যে কস্মিনকালেও সম্ভবপর নয়, অর্থনীতির এই জলবৎ তরলং সারসত্যটি দিনের আলোর মতো প্রতিষ্ঠিত সত্য।

কার্যত রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অন্ধকারে রেখে দু-পাঁচজনের অপরিণামদর্শিতার ফল এখনও ভুগতে হচ্ছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী দেশের সর্বস্তরের মানুষকে। কিন্তু সেই ফ্লপ শোয়ের সর্বাধিনায়ক আজও বহাল তবিয়তে মসনদে আসীন। অথচ তাঁর ভুল নীতির কারণে দেশের বহু ছোট বড় মাঝারি মাপের কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে, বহু ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে গেছে। নিজের অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সত্ত্বেও ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে না পারায় মেয়ের বিয়ে স্থগিত হয়েছে, বাবা-মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ে অসহায় কিংবা কপর্দকশূন্য অবস্থায় হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে হরিদ্বার থেকে মহাজনের দ্বার।

গদি মিডিয়া রঙ বেরঙের কাসুন্দি লিখেছে, দেখিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা দেশদ্রোহের অপবাদ থেকে বাঁচতে সত্য থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেফটি জোনে বিচরণ করেছেন। কেউবা মিডিয়ায় বিট-বাইটের খেলায় মেতেছেন। নোটবন্দির নামে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া বা অর্থনীতিকে প্যারালাইজড করে দেওয়ার পরেও কেউ চোখে চোখ রেখে বলতে পারেনি, রাজা তোর কালো টাকা কোথায়? তাই রাজার সিংহাসন আজও এতটুকু টলেনি।

দিন আসে দিন যায়। রাতের বুক চিরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আবার যথাসময়ে নতুন সূর্যোদয় হয়। দিনের আলো ফুটলে আমরা চায়ের কাপে তুফান তুলি। ভুলে যাই কালকের কথা। অতীত আঁকড়ে লাভ কী? স্মৃতি সততই সুখের নয়। তাই কষ্ট হলেও সব কিছু গা সওয়া করে নিতে রপ্ত করেছি আমরা। কারও কোনও হেলদোল নেই। ৬ বছর পর এসব লেখা মানে কেউ বলবে কাজ নেই তাই খই ভাজছে। ওসব বস্তাপচা কাসুন্দি এখন আর ঘেঁটে লাভ কী? তাই এখন আর কেউ আচ্ছে দিন নিয়ে চায়ে পে চর্চা করে না।

এখন বুঝতে পারছি ব্রিটিশরা কেন আমাদের ওপর ২০০ বছর শাসন চালাতে পেরেছিল। গত ৬ বছরে (অবশ্য এই ৬ বছরের সঙ্গে ভারতের নোটবন্দির কোনও সম্পর্ক নেই) বিলেতে ৫ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফল বিপক্ষে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই ইস্তফা দেন ডেভিড ক্যামেরন। তারপর প্রধানমন্ত্রী হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেরেসা মে। তিনি ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হওয়ায় ২৪ জুলাই ২০১৯ পদত্যাগ করেন।

এরপর শিকে ছেঁড়ে বিদেশমন্ত্রী বরিস জনসনের। যাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে শত প্রশ্ন থাকলেও কাকতালীয়ভাবে মসনদে বসেন। তাই তাঁকে অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার বলা হত। জনসন ভেবেছিলেন ট্রাম্প বাবাজী পার কারেগা। কিন্তু ট্রাম্প নিজেই কুপোকাত হওয়ায় স্টেপনির অভাবে আগস্ট ২০২২ পড়ে যায় জনসনের নড়বড়ে গদি। এবার এলেন লিজ ট্রাস। মাত্র দেড় মাসের মাথায় তাঁকেও বিদায় নিতে হল (৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ অক্টোবর ২০২২)। আব কি বার ঋষি সুনাক সরকার। এখন আপাতত চলছে। কিন্তু কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।

মনে রাখতে হবে ব্রিটেন কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশ নয়। বিশ্বের অন্যতম এলিট দেশ। একদা ইউরোপের শীর্ষাসনে থাকা দাপুটে ব্রিটেন বহু দেশ দখল করে বছরের পর বছর ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ চালিয়েছে। আমেরিকা পর্যন্ত ছিল এই ব্রিটেনেরই কব্জায়। তাই এককালে বলা হত, ব্রিটিশের সূর্য অস্ত যায় না। কিন্তু মাত্র ৬ বছরে সেই দেশে ৫জন প্রধানমন্ত্রী বদলালেন। কেউ কিন্তু খুব বড় কোনও ঘোটালা করেননি। মূলত নীতিগত কারণেই তাঁদেরকে ইস্তফা দিতে হয়েছে। তার থেকেও বলা ভালো, উদ্ভূত পরিস্থিতি তাদেরকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছে। সর্বশেষ লিজ ট্রাস মাত্র 50 দিনের মাথায় গদি হারিয়েছেন ভুল অর্থনীতির কারণে। যদিও এই স্বল্প মেয়াদে তিনি তাঁর নিজের মস্তিষ্ক প্রসূত অর্থনীতি সেভাবে প্রয়োগই করতে পারেননি।

এবার আমাদের দেশের দিকে তাকানো যাক। এ দেশে অর্থনীতি বলে আদৌ কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। নোটবন্দি থেকে জিএসটি, সর্বোপরি দু-বছরের লকডাউনে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বেকারত্ব লাগামছাড়া। কর্মহীনতায় অতীতের সব রেকর্ড ধুয়ে মুছে সাফ। বিশ্ববাজারে টাকার মূল্য একেবারে তলানিতে। এদিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সুশ্রী সীতারামণ নির্মলার ফরর্মূলা আবার অসম্ভব রকমের হাস্যকর। অতি সম্প্রতি তিনি বলেছেন, টাকার দাম কমেনি, বেড়েছে ডলারের মূল্য। এদেরকে কী আর বলা যায়, পাগল না উত্তম কুমার, নেতাজি না পাজামা?

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এরা ওস্তাদ। খাল কেটে কুমীর ডেকে আনতে এদের জুড়ি মেলা ভার। যে কোনও ব্যর্থতা ঢাকতে মারকাটারি সাফাই। সামনে হিমাচলে ভোট। গুজরাত এখন আপাতত স্থগিত। নতুন কিছু প্রেক্ষাপট তৈরির মহড়া চলছে মনে হয়। ইতিমধ্যেই গুজরাটের জন্য কল্পতরু হয়েছেন মোদিজী। ডবল ইঞ্জিন সরকার রক্ষা করতে একের পর এক প্রকল্প ঘোষণার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। ওদিকে আবার জাতীয়তাবাদী নৌকার পালে হাওয়া তুলতে হিন্দিতে ডাক্তারির বই বেরিয়ে গেছে। নো চিন্তা ডু ফূর্তি। অমিত শাহ বলেছেন, তাদের সরকার নাকি ৫০ বছর থাকবে। ৮ বছরেই দেশবাসীর নাভিশ্বাস অবস্থা। বাকি ৪২ বছরে দেশ যে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা শুনলে ঘোড়াও হাসবে।

কিন্তু দেশে এখন অন্ধভক্তদের এত দাপাদাপি যে, সত্যিই যদি ঘোড়া একটিবার হেসে ফেলে তাহলে এরা বলবে মোদি হ্যায় তো সব কুছ মুমকিন হ্যায়। খেতে না পেলে এরা দাদের মলম পর্যন্ত কবজি ডুবিয়ে চেটেপুটে খাবে। ডিজিটাল ভারত প্রমাণ করতে ওরা ফাইভ-জি চিবিয়ে খাবে। তবু বলবে, জয় শ্রী রাম। অগত্যা তথাস্তু। আমাদের এখন অপেক্ষা ছাড়া আর করণীয় কিছু নেই। দেখা যাক ২৪ এ কী দিয়ে ওরা চিঁড়ে ভেজায়? ধর্মের কল কীভাবে বাতাসে নড়ে?

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর