বোলপুর,তৈমুর খান – শান্তিনিকেতন এলে যাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি খুব বেশি করে নাড়া দেয়, তিনি হলেন বীরভূমের বাউল-কবি আশানন্দন চট্টরাজ । আমার সাহিত্যজীবনের প্রথম যৌবনে এই মানুষটির সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম বীরভূমের আর এক কবি চারুচন্দ্র রায়ের সৌজন্যেই। বোলপুরের এমন অনেক অনুষ্ঠানে এই মানুষটির গান শুনেই সারারাত জাগরণে কেটে গেছে। অমেয় প্রাণের উচ্ছ্বাস আর দরদি মনের অভিব্যক্তি তাঁর গানের সুরের ঝরনা ধারায় হৃদয়কে প্রসারিত করে দিতে পারে তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। মাটি-মানুষের প্রাণরস যেমন তাঁর গানে সঞ্চারিত হত, তেমনি সর্বশ্রেণির মানুষের কথাও উঠে আসত। লোকসঙ্গীত ও শ্রমজীবী মানুষের গানের কথা ও সুর তিনি সংগ্রহ করতেন এক নিজস্ব ঘরানায়, যার ফলে মরমে মরমে বিদ্ধ হত সহজেই। পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল যখন গাইতেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান “দেশ বিদেশের মানুষগো যাও এ বীরভূম ঘুরে” তখন সুর ও গানের কথায় শিহরন ছড়িয়ে পড়ত দেহ-মনে। কিংবা যখন স্বপ্না চক্রবর্তী গাইতেন “ও ননদি, আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে” তখন গ্রাম্যজীবনের সারল্যের কী অনাবিল মাধুর্য সুরের মোহময় সুখ উপলব্ধি করতাম তা সম্পূর্ণরূপে আলাদা এক পুলক জাগাত। আজ আশানন্দন নেই, কিন্তু তাঁর গান ও সুর আছে আর আছে এই তীর্থভূমি বীরভূম । যতদিন বাঙালির হৃদয় থাকবে, ততদিন তাঁর গানও থাকবে। যান্ত্রিক জীবনের বাইরে যে জীবন, সেই সারল্য, প্রেম, সম্পর্ক তাঁর গানেই খুঁজে পাব।
আশানন্দন চট্টরাজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১ লা জানুয়ারি বীরভূম জেলার মঙ্গলডিহি গ্রামে মামার বাড়িতে। পিতৃনিবাস ছিল হেতমপুর। পিতা ও মাতার নাম ছিল রাসবিহারী চট্টরাজ ও মালতী চট্টরাজ। স্ত্রীর নাম ছিল স্নেহলতা চট্টরাজ। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল নাটক, গান, কবিতা চর্চা। এমনকী ছবি আঁকাও। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে “গোয়েন্দা” নামক গল্প লিখে তিনি সাহিত্যজীবন শুরু করেন। গল্পটি হেতমপুর রাজ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের পত্রিকা “হাতেখড়ি”তে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। তারপর অজস্র ছন্দোবদ্ধ কবিতা ও নাটক “ক্ষুদিরাম”রচনা করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “মহেশ”গল্পটির এবং রবীন্দ্রনাথের “পুরাতন ভৃত্য” কবিতার নাট্যরূপও দান করেছিলেন। নাটকের প্রয়োজনেই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। নিজের লেখা নাটক “চাকা” সেইসময় খুব জনপ্রিয় হয়। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল : ছড়ার বই “ঝুমঝুমি”, গানের বই “বীরভূম বাউল” এবং আশানন্দন রচনা সংগ্রহ ।. উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান : ১,আমি মরছি ঘুরে…. ২,শুন রাঙা সই লো…. ৩,ঘর ছেড়ে যাব বৃন্দাবন… ৪,ও লো বর এলো…. ৫,ভাই-বোনেরা হইলাম এখন পর…. ৬, চাচাতে চাচিতে ভারি মিল…. ৭, মিনসে আমার গতর কুড়ে…. ইত্যাদি। এখনও সাহেবগঞ্জ থেকে আগত বর্ধমান মুখী যে কোনও ট্রেনে কোনও অচেনা বাউলের কণ্ঠে শোনা যায় আশানন্দনের গান। একতারা হাতে গেয়ে চলেছেন :
“ওরে যেইখানেতে যাবি ওরে
নামতে হবে সেইখানে
ঠিক করে নে ধরবি গাড়ি কোন্ ইস্টেশানে
ও রেলের চালক যিশু ভাই
কখনো বা রামকৃষ্ণ, কখনো নিমাই
আবার কখনো বা তিনজনাতে ধরম উজান বয়ে আনে”
মহান মানবতাবাদ আর সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভেতর তিনি সারাজীবনই আলো ফেলতে চেয়েছিলেন। জাত-ধর্ম নয়, পরম বাউল সাধকের মতো মনের মানুষেরই অন্বেষণ করেছেন তাঁর গানে গানে। বাইরের পরিচয় ঠিক নয়, অন্তরেই আছে আসল পরিচয় :
“খোলস নিয়ে ছেঁড়া ছিঁড়ি চলে এই ধরায়
প্রেমপাখি রয় মনগহনে
তারে ছুঁতে পারে ক’জনায়…”
এই প্রেমপাখিকে আমরা ছুঁতে পারি না বলেই আমাদের সমাজে এত বিভেদ হানাহানির সৃষ্টি হয়। মানুষ তো মানুষই, তার আবার অন্য পরিচয় কেন থাকবে?
আশানন্দন চট্টরাজ রসিকতা করেও তত্ত্বকথা বলতে ভুলতেন না। কখনও নেচে নেচেই আসর মাতিয়ে তুলতেন। ক্লান্ত হতেন না। বীরভূম জেলার যে কোনও জায়গায় তাঁকে পাওয়া যেত। সিউড়িতে, জয়দেব-কেন্দুলিতে, লাভপুরে, সাঁইথিয়ায়, দুবরাজপুরে তাঁকে বহুবার পেয়েছি। ১৪০০ সাহিত্য পত্রিকার আসরে মাড়োয়াড়ি ধর্মশালায় তিনি একবার নেচে নেচে গেয়েছিলেন :
“পয়সা দিয়ে দাঁত কিনেছি
চিবিয়ে খাব কলাই ভাজা”
কী মজার গান। তাঁর সামনের কয়েকটি দাঁত ছিল বাঁধাই করা। আর তাই নিয়ে রসিকতা করে গান গাইলেন। অনেক সময়ই দেখেছি, গান লিখেননি, খাতাপত্র কিছু নেই তাতে তিনি পরোয়াও করতেন না। তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখেই রচনা করে নিতেন। এরকমই অসম্ভব এক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কুলি-কামিন, শ্রমিক-চাষি সকল মানুষই তাঁর কাছে আপনজন। নিজের বুকে টেনে নিতেন। চায়ের দোকানে চা পান করতে করতেই বলতে পারতেন গানের কয়েক কলি। সারাজীবন অসংখ্য সাধারণ মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন। তাঁর সেই প্রতিভার কি আমরা যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছি?
না, পারিনি। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর সিউড়ি সদর হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর ১০ বছর পরও তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর তেমন আয়োজন বীরভূমবাসী করছে বলে মনে হচ্ছে না। গানের রাজা, কিংবদন্তির মানুষ আশানন্দনের কাছে আমরা সবাই ৠণী। সাঁওতাল বিদ্রোহের গান, সাক্ষরতার গান, শিক্ষকদিবসের গান কত কত তাঁর গানের ব্যাপ্তি। জয়দেব-কেন্দুলিতে এলে এখনও শুনি :
“আয়রে ছুটে বীরভূমের এই গ্রাম কেন্দুলিতে
যেথা প্রেমের উজান বয় অজয়ে
পৌষের শেষে হিম শীতে….”
ভুলতে পারি না। এই সুরেই ভিজে যাই। স্বপ্ন দেখি নতুন মানবসমাজের, যেখানে কোনও ভেদাভেদ নেই। যেখান প্রেমই ধর্ম। সবার উপরে মানুষ সত্য।