Thursday, June 12, 2025
30 C
Kolkata

“ভূস্বর্গে রক্তক্ষরণ, সামাজিক আচরণ-অবনমন, সাম্প্রদায়িকতার বিচরণ !!”

মৌলবাদী মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ সন্ত্রাসবাদীরা গত ২২ এপ্রিলে পেহেলগাঁও ২৮জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করলো ।তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক।

এই খবর পেয়ে আমি কি রাগান্বিত? অবশ্যই। কিন্তু নিহতদের পরিবার ও তাদের বন্ধুদের কষ্টের তুলনায়, এ কিছুই নয়।
তাঁরা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, সে বেদনা অন্যরকমের, অন্যমাত্রার।

এই দুঃখ ও যন্ত্রণার মুহূর্তে, আমরা সামাজিক মাধ্যমে সমস্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রোধের ঢেউ দেখতে পাচ্ছি—কীভাবে তাদের নির্মূল করা উচিত, নিষিদ্ধ করা উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
মৌলবাদীরা ভিন দেশের মদতপুষ্ট হলেও, তারা যেহেতু মুসলমান তাই ভারতীয় মুসলমানদের ওপরে এক অদ্ভুত ক্রোধ নেমে আসছে। তাদের কে প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে যে তারা কি আদৌ ভারতীয় কিনা।
সমাজের সেই অংশের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি হয়তো আপনাদের যুক্তি বুঝতে পারছি না, কিন্তু আপনার এই মতামতের কারণ কি তা ভাবার চেষ্টা করছি ।

তা বোঝার উদ্দেশ্যে, আসুন আমরা একটু গভীরে যাই। যে কাঠামোর দিকে আমাদের এই সমাজকে মৌলবাদীরা ঠেলে দিচ্ছে, তা একটু ভাবার এবং বোঝার চেষ্টা করি।

বিশ্ব ইতিহাস দেখলে সন্ত্রাসবাদের উদ্দ্যেশ্য খুবই স্পষ্ট:
১. সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করা।
২. তারপর মৌলবাদীদের উস্কে দেওয়া, যাতে অনিশ্চয়তাকে ঘৃণায় পরিণত করা যায়।
আর তারপর? খাবার প্রস্তুত।

  • সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
  • সংখ্যালঘুরা যেহেতু রাষ্ট্র দখল করার মতো শক্তি রাখে না, তাই সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা – সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় ।
    এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু ধর্মভিত্তিক হতে পারে, তবে তা জাতিগত, ভাষাগত, বর্ণভিত্তিক বা অন্য কোনো ভিত্তিতেও হতেই পারে।

উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক,
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া হয়ছিল সোভিয়েত-সমর্থিত নাজিবুল্লাহ সরকারকে উৎখাত করতে।
তালিবানকে সংগঠিত করা হয়েছিল; আল-কায়েদা, বিন লাদেন—বিভিন্ন দাবার গুটি নিপুণ ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, খাড়া করা হয়ছিল মুজাহিদিন ফোর্সেস।
তার ফলাফল? একটি ফ্যাসিবাদী তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা পেল। আর নাজিবুল্লাহ কে ইউনাইটেড নেশনস এর অফিস থেকে টেনে হিঁচড়ে বার করে, জনসমক্ষে হত্যাও করা হলো।

আর সেই একই তালিবান, যখন মার্কিন-আফগান যুদ্ধের পর, সংখ্যালঘুতে পরিণত হলো, তখন সেই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে রূপান্তরিত হলো।

সন্ত্রাসবাদ সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে, সেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন সন্ত্রাসবাদকে আরও উসকে দেয়, উসকে দেওয়া সন্ত্রাসবাদ আরও সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে—চক্রটি যথাক্রমে চলতেই থাকে।
সারমর্ম: সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, গ্যাসোলিন দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টার সমতুল্য।

অনেক ইতিহাস হলো, এবার আজকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি:
একটি জাতি, একটি সম্প্রদায় হিসাবে আমরা শোকাহত। কিন্তু কিছু প্রশ্ন করা জরুরি এবং কিছু আবেদন জানানো প্রয়োজন।

প্রথমত:
কেন্দ্র সরকারের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি: আমাদের কি আশ্বাস দেওয়া হয়নি যে ৩৭০ ধারা বাতিল করলে জম্মু-কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়ে যাবে?
কেন এমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করায়, আজকে তাদের নিকটজনকে হারাতে হলো? এই দায় এড়াতে সরকার পারে না। জম্মু কাশ্মীর এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল, সুরক্ষা প্রদান করা তাঁদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি: আমাদের প্রযুক্তিগত আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এটা সম্ভব হলো? কোনো গুঞ্জনই কি আপনাদের কানে এলো না ?
ভারতীয় রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা আপনাদের হাতে, তবুও আপনারা ঘুমিয়ে ছিলেন!

দেশজুড়ে মুসলমান সমাজকে  নিজেদের সম্প্রদায়কে ভোটব্যাংক রাজনীতি, স্বল্পমেয়াদি সুবিধা ও ধর্মীয় দাবিদাওয়ার জাল থেকে বের করে আনতে হবে।
তাদের এই ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলায়, দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি, দারিদ্র্য থেকে উত্তরণ এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, ধর্মীয় প্রতীকীর তুলনায় ।

কাশ্মীরের জনগণের প্রতি: প্রতিটি গুলি কাশ্মীরের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা বুঝি। তবুও, আপনাদের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয়।
পর্যটকদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করা আপনাদের নিজেদের রুটি রুজির যোগাড় নিশ্চিতি কোরনের জন্যেই জরুরি। কোনো প্রকার উগ্রবাদকেই এই পথের কাঁটা হতে দেওয়া যাবে না।
পর্যটকরা কাশ্মীরের রাজনীতির অংশ নন—তারা এখানে আসেন এই স্থানের সৌন্দর্য দেখতে, ভিতরের ভালোবাসা থেকে। তাদের প্রতি ঘৃণা একদিন এমন আগুনে পরিণত হবে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হবে না।
আপনাদেরই নিশ্চিত করতে হবে, কিভাবে এই সন্ত্রাসের বীজ আপনাদের ভূমি থেকে উৎখাত করা যায়। আপনারাই পারবেন কোনও বন্দুকের নলের ভীতি তা করতে পারবে না।

কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি: এই সময় আপনাদের মূখ্য ভূমিকা নিতে হবে ভারতের সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পেতে এবং কাশ্মীরের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথ থেকে বাঁচাতে ।
ভারতীয় গণতন্ত্রে অংশ নেওয়ায় আপনাদের উপর সর্বদাই আক্রমণের ঝুঁকি থাকে সে কথা জানি, কিন্তু এখনই সময় এই সংগ্রামকে নতুন করে শুরু করার।
আপনাদের কাছে উপায় এবং প্রভাব আছে—মৌলবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার চালানোর। ব্যাপারটা কঠিন ও ভয়ঙ্কর? হ্যাঁ। কিন্তু এই কঠিন বাস্তবতা সহ্য করতেই হবে, এই সাহস দেখাতেই হবে।
আমি বিশ্বাস করি, এই নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে উপত্যকায় যে জনরোষ তৈরি হয়েছে, তাকে ইতিবাচক হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পুঁজি আপনার আছে।
কাশ্মীরিদের এই জনরোষই, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের চিরতরে উৎখাতের পথ প্রশস্ত করবে ।

সবশেষে, স্বজন হারানো শোকাহত পরিবার ও তাদের বন্ধুদের প্রতি: আমি ক্ষমাপ্রার্থী একজন ভারতীয় হিসাবে। আমাদের নেতারা ব্যর্থ, এই রাষ্ট্র ব্যর্থ, আমরা ব্যর্থ।

নিঃসন্দেহে এই রাগ ও বেদনা সামলানো কঠিন, কিন্তু আমরা যে সাম্প্রদায়িকতার পথ নিতে অনেকে আগ্রহী, তা আমাদের সমাজকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে পরে যে আমরা শেষ পর্যন্ত সেই প্রতিবেশী দেশগুলোয় পরিণত হব, যাদের মতো হওয়া সর্বদাই আমাদের সকলের কাছে অবাঞ্চনীয় ।

মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের প্ররোচনাকারী সমস্ত বহিঃশক্তিকে , স্পষ্ট বুঝিয়ে দিতে হবে যে এই দেশে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই।
আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্ত ঘাম এই মাটিতে মিশে আছে। প্রতিটি ধূলিকনা, আকাশ বাতাস সেই লড়াই যন্ত্রণা ও সীমাহীন ত্যাগের সাক্ষী, সে সমস্ত কিছুকে আমরা কোনোভাবেই বিফলে যেতে দিতে পারি না। বিফলে যেতে দেবো না!

Hot this week

দিল্লির দ্বারকায় বহুতলে ভয়াবহ আগুন থেকে বাঁচতে ৯ তলা থেকে লাফ দিয়ে একই পরিবারের তিনজনের মর্মান্তিক মৃত্যু

নয়াদিল্লি: মঙ্গলবার সকালে দিল্লির দ্বারকা সেক্টর-১৩ এর শাপাথ সোসাইটিতে...

রাজস্থানের চুরুতে মহিলা কনস্টেবলের উপর ডিএসপি সুনীল ঝাঝড়িয়া হাত তোলার ভিডিও ভাইরাল, তদন্ত শুরু

রাজস্থানের চুরুতে একটি ভাইরাল ভিডিও ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে। ভিডিওতে...

Topics

Related Articles

Popular Categories