~ড: লায়লা আক্তার রাত্রি
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, বাঙ্গালীর রাখাল রাজা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার নিভৃত গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় এক ছোট্ট শিশু জন্মগ্রহণ করেন নাম তাঁর খোকা। এই ছোট্ট খোকাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে তাঁর জন্মদিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্মের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বাঙালিকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতিই নন, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস তিনি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারতো না আর আমরাও কখনো স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মমর্যাদা অর্জন করতে পারতাম না।
একজন বঙ্গবন্ধু, একজন শেখ মুজিব, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ক্ষণজন্মা নেতা খুব কমই জন্মে। যিনি নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন নেতা বিরল। আমাদের জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবন বাজি রেখে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। নির্দেশ দিয়েছিলেন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। বাংলার জনগণ তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলো সেদিন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ২০ বছরের সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো । বাঙালি জাতি মুক্তি পেয়েছিলো শোষণ থেকে, পরাধীনতা থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছিলো সেদিন বাংলা মায়ের সন্তানেরা।
২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা শুরু করেছিল ঠিক তখনই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধে বিজয় যে অবশ্যম্ভাবী সে নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি তাঁর নির্দেশ পালন করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছিলো এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে তাকে কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।
আর তাইতো ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জন করলেও প্রকৃত মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। কারণ সেদিন বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল ভারতের অগ্নিগর্ভে জন্ম নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শৈশব থেকেই জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতন দেখেছেন।
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ব্রিটিশ-শোষণ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হলেও বাঙালির ওপর জেঁকে বসে পাকিস্তানি-শোষণ-নির্যাতন। ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু থেকেই বাঙালির ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখন থেকেই প্রতিবাদী হয়ে উঠে বাঙালি জাতিব।
৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক আন্দোরনের পথ পেরিয়ে শেখ মুজিব বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। যার বহি:প্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। সাত বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন।
১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি। ওই কলেজের বেকার হোস্টেলেই থাকতেন তিনি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিএ পাস করেন। তিনি ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাবিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সক্রিয় অংশ নেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকেন। বাঙালির ওপর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নেমে আসে জেল-জুলুম নির্যাতন। রাজনৈতিক জীবনে এক যুগেরও অধিককাল তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন।
দুইবার তিনি ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। ১৮ বার কারাবরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি শাসক চক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সব আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন।
১৯৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬ এর আন্দোলন আর ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান , ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয় সবই জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একেকটি মাইলফলক। আর এই সংগ্রামের নেতৃত্ব ও বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন। জাতি পিতা সদ্য স্বাধীন দেশকে যখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী, দেশি-বিদেশি চক্ররা জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে থেমে যায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি!
আজ আবার জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ উন্নয়ন আর অগ্রগতির পথে অনেকধাপ এগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ হতে চলেছে।
জাতির পিতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বাঙালি জাতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
***ড. লায়লা আক্তার রাত্রি
লেখক, গবেষক, কলেজের অধ্যক্ষ্যা, রাজনীতিবিদ
চেয়ারম্যান, সোস্যাল ওয়ার্ক এন্ড রিসার্চ সেন্টার