সঞ্জয়কুমার দাস,ফরাক্কা: গ্রন্থকার-সম্পাদক-প্রকাশক ত্রয়ীকুলই কিঞ্চিদধিক অভিপ্রায় ধরেন, তাঁর বা তাঁদের সৃষ্টির বার্তা প্রসারলাভ করুক পাঠক-মানসে। কিন্তু অভিপ্রায় থাকলেই তা কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয় না। সেজন্য প্রয়োজন যথাযোগ্য সৃষ্টির যথাযোগ্য আলোচনা। অর্থাৎ সমালোচনা। কিন্তু সমালোচনা নামক অট্টালিকা নির্মাণের উপাদানসমূহ বা!, অসাধারণ, দারুণ, খুব সুন্দর, অভিনন্দন, শুভেচ্ছাতেই সীমাবদ্ধ নয়। একার্থে এগুলিকে অলংকার বলা যেতে পারে। অলংকারের সৌন্দর্য্য-বর্ধিষ্ণুতা সন্দেহাতীত। কিন্তু সেইসঙ্গে স্মরণে রাখা একান্ত জরুরি যে, সৃষ্টিকে ভেতর থেকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারলে বাহ্যিক অলংকার নিষ্প্রয়োজন। ‘বর্ণিক’ যে সেপথে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে তা আর বলতে। তাই প্রকৃত সমালোচক শুধু সুন্দরের পূজারী নন, অসুন্দরকে সুন্দরের সরণিতে আনয়নে সদা সচেষ্ট। সমালোচক ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’ নন, তিনি ত্রুটি উল্লেখপূর্বক উত্তরণের পথও বাতলে দেন। তিনি আপন প্রতিভার রশ্মিচ্ছটায় পাঠককে সম্মোহনী বাণে আকুল করে তোলেন সৃষ্টির অভিমুখে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, অদ্যকার মসিচালক সে প্রতিভা-রহিত। তাই এ আলোচনাটিকে ‘সমালোচনা’র স্থলাভিষিক্ত করণের ধৃষ্টতা আমার নেই। বরং এটিকে ‘পত্রিকা পরিচয়’ বা নির্দিষ্ট সংখ্যাটির অভিজ্ঞান পত্র হিসেবেই বিবেচনা যুক্তিসংগত।
জন্মলগ্ন থেকেই ‘বর্ণিক’-এর পাঠকপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। প্রাচীন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ অমোঘ বাণী ‘বর্ণিকে’র ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য৷ বর্তমান সাহিত্য দিশারীদের পেয়ে পত্রিকাটি এক মূহুর্তের জন্যও বিস্মৃত হয়নি অতীত নক্ষত্রদের যথাযোগ্য শ্রদ্ধা প্রদর্শনে। অধুনা সংখ্যাটি তারই আজ্ঞাবাহী। মহামারীর মহাকোপে যেসকল সাহিত্য-নক্ষত্ররাজি ইহলৌকিক যাত্রায় ইতি টানলেন, সে তালিকায় নবতম সংযুক্তি বুদ্ধদেব গুহ। বাংলা সাহিত্যে চারজন বুদ্ধের উপস্থিতি। যাদের শ্রেণিতে প্রথমেই গৌতম বুদ্ধ, দ্বিতীয়জন বুদ্ধদেব বসু, তৃতীয়জন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং চতুর্থজন বুদ্ধদেব গুহ (ক্রমটি মৃত্যুকালের নিরিখে)। মধ্যযুগীয় সাহিত্যে চন্ডীদাস সমস্যা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলেও পদবীর কারণে এখানে তেমনটা ঘটেনি। সম্প্রতি গত ২৯ অগস্ট ২০২১ তারিখে বুদ্ধদেব গুহ পরলোকগমন করেছেন। আর ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর স্মরণ সংখ্যা প্রকাশ করে রীতিমতো অবাক করেছে ‘বর্ণিক’। ইতিপূর্বেও জন কীটস, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত প্রমুখকে নিয়ে স্মরণ সংখ্যায় হাত পাকিয়েছে পত্রিকাটি।
অধুনা সংখ্যাটিতে বুদ্ধদেব গুহের লেখা দু’টি অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তি পরিসরে লেখা হলেও পাঠকের নিকট এ এক অমূল্য সম্পদ। প্রত্যক্ষভাবে দেখা ও জানার অভিজ্ঞতায় ভর করে সৈয়দ হাসমত জালাল মহাশয় যে আবেশ প্রস্তুত করলেন, তথ্যের ভান্ডার গড়ে দিয়ে যে ক্ষেত্র নির্মাণ করলেন, সে ক্ষেতে বিচরণের সুযোগধন্য আমরা খানিকটা অবকাশ পেলাম, ব্যক্তি বুদ্ধদেব গুহের একটু কাছে আসতে। সাহিত্যিকের চোখে আরেকজন সাহিত্যিকের অনুসন্ধান রূপ পেয়েছে বিনোদ ঘোষাল মহাশয়ের লেখাটিতে। উত্তর আসবেনা জেনেও সুমন গোস্বামীর চিঠিটির আকুলতা আমাদের মথিত করে। সৌম্য ঘোষ, অর্ণব মিত্র, অজন্তা রায় আচার্য, সুবর্ণা সেন, ইউসুফ মোল্লা প্রমুখের গদ্যরাজ্যে অবগাহনের মধ্য দিয়ে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’তে স্নাত হওয়ার সুযোগ পাবেন পাঠক। কবিতাগুলিতেও। সেইসঙ্গে নিয়মিত বিভাগে রয়েছে দশটি পৃথক আঙ্গিকের অবতারণা।
সাহিত্যিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে হালকা হাসির ফোয়ারা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে টানটান উত্তেজনা। বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব এখানে প্রকট। আবার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মানবতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে যেভাবে ‘টোপ’ কাহিনি রচনা করেছিলেন, নামকরণের সাদৃশ্য থাকলেও এ সংখ্যার ‘টিকটিকির টোপ’-এ তেমন ভয়ঙ্করতা নেই। গল্পের সমাপ্তিতে পাঠক হৃদয় করুণ রসে জরিত হবে না, গল্পের সমাপ্তি হবে স্মিতহাস্যেই। কবিতায় কাকে ছেড়ে কার কথা বলি। অস্থির মানুষের গল্পগাথায় সাতকর্ণী ঘোষ, গাঁওবুড়োদের ললাটলিখনে প্রভাত চৌধুরী মহাশয় অনন্য। অন্যান্য বিভাগে নিরঞ্জনবাবুর লোককথায় সোঁদা মাটির গন্ধ, কিংবা দীপঙ্কর সরকারের অক্ষয়-আলোক যেমন প্রতিফলিত তেমনই পারিজাত ব্যানার্জীর পুজোকথায় হয়ে পড়ি নষ্টালজিক। সবমিলিয়ে এক ‘সব পেয়েছির দেশ’। কিন্তু সম্পাদক মহাশয়ের প্রতি একটি অনুযোগও আছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মরণ সংখ্যায় যদি উদ্দীষ্ট ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি পরিবেশনের উদ্যোগ থাকে, তবে পাঠকের নিকট, বিশেষত গবেষকগণের নিকট তা আরও গ্রহণীয় হয়ে উঠবে বলেই আমার আশা। ‘বর্ণিকে’র সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি যে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে তা বলাইবাহুল্য।