ডাঃ শাহাদাত হোসেনের মেডিকেল টিপস ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20200724-WA0029

এনবিটিভি, ডক্টর শেখ শাহাদাত হোসেন, ২৪ জুলাই : এলাহাবাদ সেন্ট্রাল রেলওয়ে হসপিটাল হেডকোয়ার্টার, রেসিডেন্সি মেডিক্যাল অফিসার

জাফর এসেছে বর্ধমান থেকে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে। অনেক চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক শেষে হতাশ মা, মেয়ের জন্ডিস ভালো হচ্ছে না আজ দুমাস হলো। শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো, বাচ্চাকে সবাই ভালো করে দেখলো। সব কিছু স্বাভাবিক শুধু চোখ মুখ, গায়ের চামড়া হলুদ হয়ে আছে। রাউন্ডে বড় ডাক্তার সাথের জুনিয়রদের প্রশ্ন করলো, ” তোমরা কেউ মাকে জিজ্ঞেস করেছো, সে বাচ্চাকে কি খাবার খাওয়ায়? ”

সবাই অবাক। খাবারের সাথে এর কি সম্পর্ক? হেপাটাইটিস এ বি ই সবই তো নেগেটিভ এসেছে। মাকে জিজ্ঞেস করা হলো খাবার নিয়ে। জানা গেলো, বাচ্চার বাবা সবজি বিক্রেতা। প্রতিদিনের বেঁচে যাওয়া সবজি থেকে গাজর আর মিষ্টি কুমডা নিয়ে মা খিচুড়ি বানিয়ে খাওয়ায় বাচ্চাকে। অন্য কিছু নাকি বাচ্চা খেতে চায় না।

ক্রমাগত গাজর, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, পালং শাক খাওয়ালে এতে থাকা বিটা ক্যারোটিন নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে এত পরিমাণে জমা হয় যা লিভার শরীর থেকে বের করতে পারে না এবং শরীরে জমে চামড়ার রং হলুদ করে ফেলে। আবার যদি এসব খাবার বন্ধ করা হয় তাহলে ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে শরীরের রং স্বাভাবিক হয়ে যায়। মেডিকেল টার্মে একে বলা হয় “হাইপারক্যারোটেনিমিয়া”।

এতো গেলো এক ধরনের জন্ডিস। এছাড়াও বাচ্চাদের আরো কিছু জন্ডিস হয় যা আমার আজকের আলোচনার টপিক।

মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জন্ডিসঃ

১. মা নেগেটিভ রক্তের হলেঃ

মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় তাহলে বাচ্চার জন্মের পর পর মাকে এন্টি ডি ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেয়া হয় যদি বাচ্চার গ্রুপ পজিটিভ হয়। সাধারণত ১ম বাচ্চার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না, এরপরের বাচ্চাদের জন্মের পর পরই জন্ডিস দেখা দেয় এবং এত বেশি জন্ডিস হয় যে অনেক সময় বাচ্চাকে ফটো থেরাপি দেয়ার পাশাপাশি রক্ত পাল্টাতেও হয়। নাহলে বাচ্চার খিচুনি সহ, মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার আশংকা থাকে।

২. মা হেপাটাইটিস বি পজিটিভ হলেঃ

মা যদি হেপাটাইটিস বি পজিটিভ থাকা অবস্থা প্রেগনান্ট হয় তাহলে বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে বাচ্চা ডেলিভারির সময়। বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই বাচ্চাকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দিতে তো হবেই সাথে হেপাটাইটিস বি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ( HBIG) দিতে হবে। পরবর্তীতে এই বাচ্চা ২,৪,৬ মাসে ভাক্সিন পাবে বা নরমাল টিকা সিডিউলে ঢুকে যাবে।এরপর ৬ মাস পর টেস্ট করবে হেপাটাইটিস বি এর। মা ছাড়া পরিবারের অন্য কেউ যদি হেপাটাইটিস বি পজিটিভ হয় তাহলে বাচ্চাকে শুধু ভ্যাকসিন দিলেই হবে।

৩. স্বাভাবিক জন্ডিস ( Physiological)

জন্মের পর ৩-৫ দিন বয়সে বাচ্চার চোখ মুখ ও বুকের উপরিভাগ হলুদ দেখা যায়। এটা স্বাভাবিক জন্ডিস, মারাত্মক কিছু না। বাচ্চার পায়খানা রং সাদা না হলে, বাচ্চা হাসিখুশী, খাওয়া ঘুম পেশাব ঠিক থাকলে ভয়ের কিছু নাই। সকালের হালকা রোদ বা ৭ঃ৩০ -৮ টার দিকে যে আলোটা জানালা দিয়ে ঢোকে তাতে কাপড়চোপড় ছাড়া চোখ ও প্রশ্রাবের স্হানটুকু ঢেকে ১৫-২০ মিনিট বাচ্চাকে রাখতে হবে। তাহলেই আস্তে আস্তে জন্ডিস কমে যাবে।

৪.বুকের দুধ চলা বাচ্চার জন্ডিসঃ

স্বাভাবিক জন্ডিস অনেক সময় কমতে সময় লাগে। ১ মাসের বেশিও থাকে। বাচ্চা এক্ষেত্রে স্বাভাবিক থাকে, কোন শারীরিক সমস্যা ছাড়াই। শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়া বাচ্চার জন্ডিস কমাতে কখনই বুকের দুধ বন্ধ করা উচিত নয়। এই জন্ডিস ধীরে ধীরে কমলেও কোন ক্ষতি হয় না।

ক্ষতিকর জন্ডিসঃ

১. পিত্তথলির সমস্যাঃ

পিত্তথলি বা গলব্লাডারের জন্মগত ত্রুটির কারনে অনেক সময় জন্ডিস দীর্ঘমেয়াদী হয়। জন্মের পর স্বাভাবিক হলুদ পায়খানা করার বদলে এরা সাদা পায়খানা করে। সারা শরীর খুব তাড়াতাড়ি হলুদ হয়ে যায় ও সহজে কমে না। ২ মাস বয়সের মধ্যে অপারেশন না করলে এই রোগ ভালো হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। পরবর্তীতে লিভারে সমস্যা দেখা দেয়।

২. হাইপো থাইরয়েড বা গলগণ্ড রোগঃ

বাচ্চার গলায় অবস্থিত থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে জন্মগত ত্রুটি থাকলে থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি তৈরি হয় ও বাচ্চার জন্ডিসসহ কষা পায়খানা, কান্নাকাটি কম করা, নিস্তেজভাব, পেট ফুলে থাকা সহ বিভিন্ন মানসিক ও শারিরীক সমস্যা দেখা যায়। দ্রুত রোগ ধরে ঔষধ শুরু করলে এই রোগ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৩. হেপাটাইটিস ভাইরাসঃ

গায়ে গায়ে জ্বর, দূর্বলতা, বমি, খাবারে অরুচি থাকলেই জন্ডিস বলে ঝাড়াতে শুরু করেন অনেকে। কিন্তু চোখ ও পেশাব হলুদ না হলে ও পরীক্ষায় বিলিরুবিন ও লিভার এনজাইম না বাড়লে তাকে জন্ডিস বলা যাবে না।

জন্মের সময় বা রক্ত নেয়া ছাড়া, বাচ্চাদের সাধারণত হেপাটাইটিস এ আর ই বেশী হওয়ার চান্স থাকে বাইরের পঁচাবাসি খাবার বিশেষ করে পানীয় থেকে। এজন্য বাইরের খোলা খাবার বা পানীয় বাচ্চাদের দেয়া উচিত নয়।

এসব ক্ষেত্রে বাচ্চাকে তেল চর্বি, ভাজা পোড়া, বাইরের রিচ ফুড না দিয়ে ঘরের সহজ পাচ্য খাবার নরম ও তরল খাবার দেয়া উচিত। প্রতিদিন নিয়মিত পায়খানা হওয়া জরুরী। নাহলে ঔষধ দিতে হয়। সবচেয়ে বেশী জরুরি বাচ্চার বিশ্রাম। নাহলে জন্ডিস বেড়ে বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।

প্রতিরোধঃ

এখন সরকারি বেসরকারি ভাবে হেপাটাইটিস বি এর টিকা দেয়া হয়, বেসরকারিভাবে হেপাটাইটিস এ টিকাও চালু আছে।

হেপাটাইটিস বি এক মাস অন্তত অন্তর তিনটা ডোজ ও হেপাটাইটিস এ ২টা ডোজের । ১ম ডোজ যে কোন দিন এবং ২য় ডোজ প্রথমটার ৬ মাস পর।

জন্ডিসের আরো অনেক কারণ আছে। তবে মোটামুটি সচরাচর হওয়া জন্ডিসগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম। আশা করি সবার কাজে লাগবে।

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর