Pandora Papers: দুনিয়ার সব চেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ফাঁস! আম্বানি, সচিন,পুতিন– কে বাকি আছেন!

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

images (14)

সৌম্য মন্ডল

“এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি” রবীন্দ্রনাথ এমনটাই লিখে গেছেন। যদিও কোথাও কিছু চুরি গেলে বাবুদের সন্দেহ যায় সব চেয়ে গরিব মানুষটার দিকে। যদিও যত দিন যাচ্ছে, ততই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে দুনিয়ায় সব চেয়ে ধনী ব্যক্তিরাই সব চেয়ে বড় চুরি গুলো করে থাকে।

এখনো পর্যন্ত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস করলো ইন্টারন্যাশেনাল কনসোডিয়াম ওফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (ICIJ)। ইন্ডিয়ান ইক্সপ্রেস সহ দুনিয়ার ১৫০টা সংবাদ সংস্থার ৬০০ জনের মত সাংবাদিক বছর খানেক ধরে ১ কোটি কুড়ি লক্ষের কাছাকাছি গোপন নথিপত্রের ফাইল পরীক্ষা করে ফাঁস করেছেন এই কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির নাম দেওয়া হয়েছে “প্যান্ডোরা পেপারস”।

গ্রীক পুরাণের প্যান্ডোরার বাক্সের কাহিনির সঙ্গে তুলনা করেই এই তদন্তের নাম “প্যান্ডোরা পেপারস” নাম দেওয়া হয়েছে। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী প্যান্ডোরা হলেন ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রথম নারী। ঈশ্বর জিউস- এর নির্দেশে দেবতা হেফাস্টাস প্যান্ডোরাকে তৈরি করেন। জিউস প্যান্ডোরাকে উপহার দিয়েছিলেন অদম্য কৌতুহল এবং খুব সুন্দর কারুকার্য করা একটি বাক্স। জিউস কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যে এই বাক্সটা যেন না খোলা হয়। কিন্তু অনেকদিন সংযমের পর আর কৌতুহল সামলাতে না পেরে প্যান্ডোরা বাক্সটি খুলে ফেলেন। এর পর কালো ধোঁয়া আর গর্জনে বাক্স থেকে পৃথিবীতে প্রথম বারের মত বেড়িয়ে এল রোগ, লোভ,কষ্ট, ঈর্ষা, হতাশা ইত্যাদি, এসব অশুভ ব্যাপার গুলো গ্রাস করলো মানবজাতিকে। যদি ক্রনি ক্যাপিটালিজমের যুগে এতবড় আকারে কেলেঙ্কারি আগে এত ব্যাপক ভাবে সামনে না এলেও, ব্যপারটা নতুন এবং অজানা নয়।

প্যান্ডোরা পেপারস’ই এখন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনামে। এই কেলেঙ্কারি তে নাম এসেছে বিভিন্ন দেশের অতি ধনীদের। যাদের মধ্যে পপ স্টার সাকিরা, খেলোয়াড়, বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী, রাষ্ট্র নায়ক সবাই আছে। ৯০ টি দেশের ৩৫ জন রাষ্ট্র নায়ক, যাদের মধ্যে প্রাক্তন এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রধান আছেন। এছাড়াও ৩০০ জনের মত ক্ষমতাশালী সরকারি আধিকারিক, মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, সামরিক কর্তার নাম জড়িয়েছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, এঁদের মধ্যে আছেন ভারতীয় ৩৮০ জন।

পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে, যাদের মধ্যে বেশীর ভাগের নামই হয়তো অনেকেই শোনেনি কখনো। যেমন শাময়া, বেলিযে, পানামা , দ্য ব্রিটিশ ভারজিন আইসল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, দুবাই, মোনাকো, সুইদজারল্যান্ডস, ক্যামান আইসল্যান্ডস ইত্যাদি। এই দেশ গুলোকে ট্যাক্স হ্যাভেন দেশ বলা হয়। Heaven বা স্বর্গ নয়, এই বানানটা হল Haven,অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়। কারণ এই দেশ গুলোতে বিদেশীদের কর দিতে হয়না বা দিতে হলেও অতি সামান্যই কর দিতে হয়। শুধু তাই নয় এই দেশ গুলোর আইন অনুযায়ী গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়া হয়। ফলত বিভিন্ন দেশের ধনীদের কাছে এই দেশ গুলো Haven বা আশ্রয় স্থল থেলে Heaven বা স্বর্গে পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ধনীরা এই সমস্ত দেশে নিজেদের আত্মীয় বা বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে বিভিন্ন রকম কম্পানি বা ট্রাস্ট খোলান। তার পর হুন্ডি বা বিভিন্ন পদ্ধতিতে জটিল লেনদেনের মাধ্যমে ঐ সমস্ত কম্পানি বা ট্রাস্টের একাউন্টে দেশের কর ফাঁকি দিয়ে টাকা পাচার করে। প্যান্ডোরা পেপারস তদন্তে দেখা গেছে ১৪ টা এমন কম্পানি আছে যাদের কাজই হল ট্যাক্স হ্যাভেন দেশ গুলোতে টাকা পাচারের জন্য বিভিন্ন দেশের ধনীদের সহায়তা করস। ঐ ধরনের টাকা পাচারে সহায়তা করে তারা দুনিয়াতে ২৯ হাজার অফ সোর কম্পানি আর ট্রাস্ট খুলতে সাহায্য করেছে। ধনীদের সম্পদ পাচারের ফলে তার বোঝা অবশ্যই বইতে হয় দেশের সাধারণ মানুষকে। পেট্রল সহ বিভিন্ন খাতে সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা চাপিয়ে সরকারকে ক্ষতি পূরণ করতে হয়।

মুকেশ আম্বানির ছোট ভাই অনিল আম্বানি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৩টি চীনা সরকারি ব্যাঙ্কের সাথে চলা মামলার প্রেক্ষিতে লন্ডন আদালতে জানিয়েছিলেন যে তার মোট সম্পত্তির পরিমাণ শূন্য। ৩ মাস পরে লন্ডন আদালত অনিল আম্বানিকে ৭১৬ মিলিয়ন ডলার ফেরৎ দিতে আদেশ দেয়। কিন্তু আম্বানি এই টাকা ফেরত দেয়নি। তিনি জানিয়েছিলেন গোটা দুনিয়ায় তার কোনো সম্পত্তি নেই। নিজেকে দেউলিয়া দেখিয়ে বেশ কিছু সরকারি সুবিধাও নিয়েছেন অনিল আম্বানি। এবার প্যান্ডোরা পেপারস থেকে জানা যাচ্ছে যে এ হ্যান দেউলিয়া আম্বানি ১৮ টি অফসোর কম্পানির মালিক হয়ে বসে আছেন। প্যান্ডোরা পেপারসে নাম আছে নিরব মোদি, সচিন তেন্দুলকর সহ আরো অনেকের।

জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার নাম এসেছে কেলেঙ্কারিতে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলারের গোপন সম্পত্তি রেখেছেন বিদেশে। এই নিয়ে সাংবাদিকদের কোনো নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজা অস্বীকার করেছেন এবং গত রবিবার জর্ডনে কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ICIJ এর ওয়েব সাইট। এই কেলেঙ্কারিতে ইংল্যন্ডের রক্ষণশীল পার্টির প্রধান তহবিল দাতা ধনীদের নাম জড়িয়েছে এই কেলেঙ্কারিতে। এমন সময় এই প্যান্ডোরার বাক্স খুলোলো যখন কিনা তাদের বাৎসরিক সম্মেলন চলছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিব্রত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তদন্তে নাম উঠে এসেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘনিষ্ঠদেরও। বরিস, পুতিন সহ বিভিন্ন অভিযুক্তরা অভিযোগকে অস্বীকার করে উডিয়ে দিলেও কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি উহুরু কেনয়াত্তার ঘনিষ্টদের নাম কেলেঙ্কারিতে জরাবার পরে, রাষ্ট্রপতি এই তদন্ত কে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন এই তদন্ত আর্থিক লেন দেনে স্বচ্ছতা আনতে ও উন্নতি করতে সাহায্য করবে। পাকিস্তানে ইমরানখানের খানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী মনিস এলাহি সহ আরো অনেকের নাম আসার পরে ইমরান খান টুইট করে প্যান্ডোরা পেপারসকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এর আগে ২০১৬ সালে ল ফার্ম মোসাক ফনসাকার অথ্য ফাঁস করে সাংবাদিকরা, যা পানামা পেপার নামে খ্যাত। পানামা পেপারের জন্য জেলে যেতে হয়েছিলো পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ সরিফকে। পানামা পেপারে বহু ভারতীয় নাগরিকের নাম এলেও এই দেশে তেমন কোনো হেল দোল হয়নি। এবার এখনো পর্যন্ত পেগাসাসের মতই প্যান্ডোরা পেপারস নিয়েও ভারতের ইউনিয়ন সরকারকে তাৎপর্য পূর্ণ কিছু বলতে শোনা যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠতে পারে যে আর্থিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে ভারত কি কেনিয়া বা পাকিস্তানেরও পেছনে চলে যাচ্ছে? দূর্নীতিই কি “আচ্ছে দিনের” স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর