~শরীয়াতুল্লাহ সোহন
ইসলামী হিজরী সালের প্রথম মাস মুহাররম। মহান আল্লাহ তাআলা আরবি ১২ টি মাসের মধ্যে চারটি কে অধিক ফজিলতপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম মুহাররম মাস। এই মুহাররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। মুসলিম জাহানের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী, আনন্দ, উৎসব আরবি মাস গুলোকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে এবং দিন গুলো আরবি মাস কে কেন্দ্র করে পালিত হয়।
ইসলামের ইতিহাসে মুহাররম মাস অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল মাস। এই মাস কে কেন্দ্র করে বহু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের দিকে যদি আলোকপাত করা যায়, তাহলে দেখা যায় মহররম মাসের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিন বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী অর্থাৎ এই দিনে অনেক কিছু হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে। মানব জাতির সৃষ্টির আদিপর্বে দিকে যদি দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে মহান রব্বুল আলামীন মহররম মাসের ১০ তারিখ আমাদের আদি পিতা হযরত আদম(আঃ) সৃষ্টি করেছেন। আবার এই দিনই সৌন্দর্য মন্ডিত জান্নাত থেকে আদম(আঃ) ও মা হাওয়া কে বিতাড়িত করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। বিশ্ব জাহানের দ্বিতীয় নবী হযরত নূহ(আঃ) দীর্ঘ ৯০০ বছর আল্লাহর পথে মানুষকে হেদায়েতের জন্য ডাক দিয়ে যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তিনি জাতির জন্য বদ দুয়া করলেন। আল্লাহ এই দুয়া কবুল করলেন এবং নূহ(আঃ) কে নৌকা তৈরির নির্দেশ দিলেন। কিছু দিন পরেই অতি বৃষ্টিতে মহাপ্লাবনের সূচনা হলো ফলে নূহ(আঃ) মুষ্টিমেয় সঙ্গী সাথী ছাড়া সবাই মারা পড়লেন এবং মহররম মাসের ১০ তারিখ অর্থাৎ এই আশুরার দিনে তাদের নৌকা জেদি পাহাড়ে গিয়ে লাগে এবং তারা পরিত্রাণ পান। এই দিনেই হযরত ইউনুস(আঃ) এর কওমের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। এছাড়া তিনি এই দিনে মাছের পেটে দীর্ঘ ৪০ দিন কাটানোর পর মুক্তি লাভ করেন । এই দিনে হযরত ইবরাহিম(আঃ) ও হযরত ঈসা(আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহিম(আঃ) ‘খলিল’ উপাধি পান এবং নমরুদের অগ্নিকাণ্ড থেকে মুক্তি পান এই আশুরার দিনে। শুধু তাই নয় এই দিনে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খাদিজা(রাঃ) কে বিবাহ করেন, মুসা(আঃ) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কথা বলেন , হযরত দাউদ(আঃ) এর দোয়া কবুল হয়, হযরত ইউসুফ ও হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর মধ্যে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর পুনরায় দেখা হয় এবং হযরত ঈসা(আঃ) দীর্ঘ দিন ইহুদিদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার পর মুক্তি লাভ করে আসমানে গমন করেন। এছাড়াও এই দিনে আল্লাহ তাআলা বিশাল আকাশ, পাহাড়-পর্বত, লাহও-কলম, ফেরশতাদের সৃষ্টি করেন। এই আশুরার দিনে আবার কেয়ামত দিবস অনুষ্ঠিত হবে।
এই আশুরার দিনে ঘটে যাওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা
প্রথম ঘটনা: এই ১০ মুহাররম অর্থাৎ এই আশুরার দিন মুসা(আঃ) এর কওম বনী ইসরাইল জাতির মুক্তির দিন। আমরা স্বাধীনতা অর্জন যে-কোনো দেশ ও জাতির কাছে অত্যন্ত গর্বের দিন। আর এই দিনেই অত্যাচারী ফেরাউনের হাত থেকে মুসা(আঃ) এর নেতৃত্বে বনী ইসরাইল জাতিকে বিজয় দান করেন।
দ্বিতীয় বেদনাদায়ক ঘটনা: এই ঘটনাটি আশুরার ইতিহাসে এক বেদনা বিধুর ঘটনা। এই দিনই ৬৮০ খ্রীস্টাব্দে এবং ৬১ হিজরীতে ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এতে মহানবী(সাঃ) দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন(রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন। কারণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও ইসলাম জাহানের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর পুত্র হযরত হোসাইন(রাঃ) খেলাফতের প্রকৃত দাবিদার ছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) মারা গেলে ইসলামী খেলাফত দায়িত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন এবং হোসাইন(রাঃ) কে পত্র যোগে তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিতে বলেন। কিন্তু হোসাইন (রাঃ) ইয়াজিদের এই প্রস্তাব ঘৃণ্যভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর পিতা হযরত আলী (রাঃ) এর খেলাফতে রাজধানী ছিল কুফা নগরী। সেখানে হযরত হোসাইন (রাঃ) অনুসারী সংখ্যা ছিলেন অনেক। এছাড়াও তিনি কুফাবাসীর কাছ থেকে খেলাফতের ব্যাপারে চিঠি পেয়েছিলেন, তাই তিনি কুফা যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন। কারণ পত্রে হোসাইন(রাঃ) কে কুফাবাসীর পক্ষ থেকে সবরকম ভাবে সাহায্য করার পুরোপুরি আশ্বাস ছিল।
তিনি যথারীতি একটি ক্ষুদ্র দল নিয়ে মদিনা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে ইরাকের পথে যাত্রা করলেন। পথে মধ্যে কাদাসিয়ার পার হওয়ার পর ইয়াজিদের এক হাজার সৈন্য বিশিষ্ট বাহিনী হোসাইনের পথ রোধ করে দাঁড়ান। হোসাইন (রাঃ) পথ ছাড়তে বলেন এবং বলেন তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে এখানে এসেছেন। কিন্তু ইয়াজিদের বাহিনী এই কথা নস্যাৎ করে দিয়ে অস্বীকার করেন। হোসাইন বাধ্য হয়ে পথ বদলে কারবালার প্রান্তরে ২ ই মুহাররম ৬১ হিজরীতে হাজির হন এবং তাঁবু খাটিয়ে সেই খানেই অবস্থান করেন।
এরপর এই স্থানেই ইয়াজিদের বাহিনী দ্বারা অবরূদ্ধ হয়ে পড়েন তারা। চারিদিক থেকে ইয়াজিদের বাহিনী তাঁবু ঘিরে ফেলেন এবং তাঁবুতে জল আসা বন্ধ করে দেন । শিশুরা জল তেষ্টায় ছটপট করতে করতে মারা যান । শুরু হয় যুদ্ধ। ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হোসাইন এর সমস্ত সঙ্গী সাথি শাহাদাত বরণ করেন। শেষ পর্যন্ত হোসাইন একাই যুদ্ধ চালিয়ে যান। হোসাইন কে ইয়াজিদ আত্ম সমর্পণ করতে বলেন কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বীরের মতো শাহাদাত বরণ করেন।
কারবালার এই ঘটনা নিয়ে হাত-পা-শরীর কেটে পালন করা সম্পূর্ণ ভাবে ইসলাম বর্হিভূত কাজ: আশুরা আসলে আমরা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ি এবং হায় হোসাইন….. হায় হোসাইন করে চিৎকার করি। হাত পা কাটি, শরীর থেকে রক্ত ঝরায় এগুলো সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী কাজ । কারণ এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আশুরার মূল শিক্ষা নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, পাপের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে রুখে দাঁড়িয়ে সত্য প্রতিষ্ঠায় নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়াই হল আশুরার প্রকৃত অন্তনির্হিত তাৎপর্য। তাই এই ঘটনার প্রায় সাড়ে চোদ্দো শো বছর কেটে যাওয়ার পরও এই দিনটি সারা মুসলিম জাহানের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
তাই শেষে অনুরোধ রাখব যে সমস্ত মানুষ জন এই পবিত্র আশুরার দিনটিকে আনুষ্ঠিকতার সাথে বুক চাপড়িয়ে, রক্ত ঝরিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করছেন তারা এই পথে সরে আসুন এবং আশুরার মূল শিক্ষা কে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত করুন। কারণ আশুরার মধ্যে নিহিত আছে কারবালার বিষাদময় ঘটনা এবং এই ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে ত্যাগের মহিমা ও সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।