২০২১ সালে যখন গোটা দেশ ধ্বংসাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে পড়ে হাহাকার করছিল, তখন মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র নিয়ে তৈরি হয়েছিল এক সন্দেহের অন্ধকার। হাসপাতালের থরে থরে শব, শ্মশানে লাইন, অক্সিজেনের জন্য হাহাকার—সবই সংবাদ শিরোনামে এসেছিল, কিন্তু সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা রয়ে গিয়েছিল বিস্ময়করভাবে কম।
ভারতের সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (CRS)-এর সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছিল ৮১.২ লক্ষে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ২৫.৮ লক্ষ বেশি। ২০১৯ সালে, কোভিড-পূর্ব সময়ে, দেশের মোট নথিভুক্ত মৃত্যু ছিল ৫৫.৪ লক্ষ। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, ২০২১ সালে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৪৭% হারে।

অবশ্য, শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং স্বাভাবিক মৃত্যুহার হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, এই সময় অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৯.৭৩ লক্ষ, যা একরকম ‘অঘোষিত কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা’ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে।
সরকারি ও বাস্তব মৃত্যুর মাঝে বিপুল ফারাক
২০২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর সংখ্যা দেখিয়েছে মাত্র ৩.৩২ লক্ষ। কিন্তু CRS-এর তথ্য সেই সংখ্যাকে একরকম ‘অসম্পূর্ণ’ ও ‘আংশিক’ হিসেবেই প্রমাণ করছে। অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যার প্রায় ছয় গুণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একধাপ এগিয়ে দাবি করে, ভারতের প্রকৃত কোভিড-সম্পর্কিত মৃত্যু ২০২০ ও ২০২১ মিলিয়ে ৩৯.১ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে, যা CRS-এর সংরক্ষিত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। এই আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ভারতের সরকার কর্তৃক সরাসরি অস্বীকার করা হলেও, দেশের নিজস্ব CRS-এর তথ্যে WHO-এর অনুমানই আরও বেশি ঘনিষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হয়।

রাজ্যভিত্তিক বিচারে উদ্বেগজনক চিত্র
রাজ্যভিত্তিক পরিসংখ্যান তুলে ধরলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি রাজ্যে সরকারিভাবে কোভিড মৃত্যুর যে সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে, তা অতিরিক্ত মৃত্যুর তুলনায় ১০ গুণ থেকে ৩০ গুণ কম।
গুজরাট: সরকার বলছে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৫৮০৯ জনের, কিন্তু অতিরিক্ত মৃত্যু ১.৯৫ লক্ষ! অর্থাৎ সরকারি সংখ্যার চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি।
মধ্যপ্রদেশ: সরকারিভাবে মৃত্যু ৬৯২৭, অথচ অতিরিক্ত মৃত্যু ১.২৬ লক্ষ – যা ১৮ গুণ।
পশ্চিমবঙ্গ: সরকার বলে ১০,০৫২, অথচ বাস্তব চিত্রে অতিরিক্ত মৃত্যু ১.৫ লক্ষের বেশি – প্রায় ১৫ গুণ।
বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান – প্রতিটি রাজ্যেই অতিরিক্ত মৃত্যু সরকারি সংখ্যার ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি।
অন্যদিকে, কেরল, দিল্লি, ও আসামে এই পার্থক্য তুলনামূলকভাবে কম, যেখানে অতিরিক্ত মৃত্যু সরকারি সংখ্যার ১.৫ থেকে ৩ গুণ।

কীভাবে এই ‘অতিরিক্ত মৃত্যু’ হিসেব করা হলো?
এই বিশ্লেষণে গবেষকরা একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। ২০১৯ সালের নথিভুক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ও সেই বছরের জনসংখ্যার অনুপাতে ২০২১ সালের প্রত্যাশিত মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়। এরপর দেখা হয় বাস্তবে ২০২১ সালে কত মৃত্যু ঘটেছে। এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য—তাই “অতিরিক্ত মৃত্যু” হিসেবে ধরা হয়।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই পদ্ধতি প্রত্যাশিত মৃত্যুহার বৃদ্ধির হারও বিবেচনায় নেয়, ফলে একে রক্ষণশীল পদ্ধতি বলা যায়। তবুও, এর ফলাফলে বিপুল সংখ্যক অনিয়ন্ত্রিত মৃত্যুর আভাস স্পষ্ট হয়।
চিকিৎসাগত মৃত্যুসনদের অভাব ও তথ্য গোপনের প্রশ্ন
এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান আরও বেশি দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায়, ২০২১ সালে নথিভুক্ত মৃত্যুর মধ্যে মাত্র ২২.৫% মৃত্যুরই চিকিৎসাগত প্রত্যয়ন (Medical Certification of Cause of Death – MCCD) ছিল। এ অর্থ দাঁড়ায় যে ৭৭.৫% মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অজানা! ফলে প্রশ্ন উঠে—কতজন সত্যিই কোভিডে মারা গেলেন, আর কতজনের মৃত্যুর কারণ ‘নথিভুক্তই’ হলো না?
সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং ডেটা ট্রান্সপারেন্সির ঘাটতির ফলে অনেক মৃত্যু হয়তো কখনোই কোভিড হিসেবে গণ্য হয়নি। আবার অনেক মৃত্যু হয়তো অন্যান্য অসুখের নামে (যেমন হৃদরোগ) রিপোর্ট করা হয়েছে, যদিও সেগুলোর পেছনে কোভিডই ছিল প্রকৃত কারণ।

রাজনৈতিক নীরবতা
এই বিপুল পরিসংখ্যান শুধু স্বাস্থ্যনীতির ব্যর্থতাই নয়, বরং তা একধরনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নীরবতার দিকেও আঙুল তোলে। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা স্বীকার করলে সরকারের দায়বদ্ধতা বেড়ে যেত, এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো তথ্য প্রকাশে অনীহা। অথচ এই বিপুল পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা নয়, বরং প্রতিটি সংখ্যা একেকটি জীবন, একেকটি পরিবার, একেকটি না বলা যন্ত্রণা।
ভারতের কোভিড পরিস্থিতি শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থার নয়, বরং গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা ও মানবিকতা পরীক্ষারও অন্যতম অধ্যায় হয়ে থাকবে। যখন WHO থেকে শুরু করে দেশের নিজস্ব CRS রিপোর্টই ইঙ্গিত দিচ্ছে কোভিডের প্রকৃত মৃত্যু সরকারি হিসেবের অনেকগুণ বেশি, তখন একটি প্রশ্ন অনিবার্যভাবে উঠে আসে—এই নীরব প্রাণহানির জন্য দায় কার?
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মৃত্যুর গোপনীয়তা কখনোই রাষ্ট্রীয় সম্মানের বিষয় হতে পারে না। বরং মৃতদের জন্য অন্তত সত্যের এক বিন্দু আলোই শ্রদ্ধার প্রধান রূপ।