ঔপনিবেশিক বাংলা ও বাঙালি মনচিত্রে ইসলামোফোবিয়া৷

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

My-project-1-30-1140x628

~ওয়াহেদ মির্জা

ইসলামোফোবিয়া’ শব্দের অর্থই তাই, ইসলামে প্রীতি ভীতি, ইসলাম নামের আদর্শকে ভয় পাওয়া, ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের কাছ থেকে ক্ষতির আশংকা করা। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফরাসি সাহিত্যে “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি আবির্ভূত হয়েছিল মুসলিম বিরোধী অনুভূতি এবং নীতির জন্য একটি উপাধি হিসাবে এবং ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে ইংরেজিতে জনপ্রিয় হয়েছিল। ইসলামোফোবিয়া হল এক প্রকার জেনোফোবিয়া বা বিদেশী বা বিদেশী জিনিসের ভয়।Islamophobia শব্দটার সূত্রপাত ‘৭০ এর দশকেই হয়, কিন্তু জনপ্রিয় হতে থাকে ‘৯০ এর দিকে এসে।এই ইসলামোফোবিয়া কি আগে ছিল না? নাকি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংস (৯/১১ )থেকেই এর শুরু?

একটু গভীরে খুঁজলে দেখা যাবে এই ইসলামোফোবিয়ার জন্মসূত্র হচ্ছে ক্রুসেডের মাধ্যমে৷ ইসলাম ও খ্রীষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধ প্রথম ক্রুসেড ,দ্বিতীয় ক্রুসেড হওয়ার পর বলতে গেলে আধুনিক যুগে যে তৃতীয় ক্রুসেড চলছে একটু অন্য আঙ্গিকে৷ তৃতীয় ক্রুসেড চলছে কারন ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর জন্য গোপন উপায় ব্যবহার করছে ইউরোপ ও ইহুদি ভূ -রাজনীতি। আর এতে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সঙ্গে আধুনিক সংগঠক ও প্রতিষ্ঠান যেমন ফেসবুক ,গুগল ,টুইটার ইত্যাদি গোপনে বিনারক্তপাতে সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম৷ সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেস রিসার্চ রিপোর্ট বলে যে 2001 এবং 2009 এর মধ্যে, ইসলামোফোবিয়া প্রচারকারী সংস্থাগুলি মোট $42.6 মিলিয়নের বেশি অবদান পেয়েছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে দিতে 5.9 বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় 6000 কোটি টাকা খরচ করেছে৷ ভারতে ইসলাম ভীতি ছড়াতে কত খরচ হয়েছে কোন সরকারি ও বেসরকারি রিপোর্ট নেই ৷ 2008-2013 সালের মধ্যে আমেরিকা ইসলামোফোবিয়া ছড়াতে খরচ করে 205 মিলিয়ন ডলার৷ লাগাতার রাজনৈতিক কোনাঠাঁসা ও ধর্মীয় চক্রান্ত চলছে৷

ইউরোপীয় মাটিতে তৈরি হওয়া ইসলামোফোবিয়া ভারতে তথা বাংলায় কি ভাবে নবজাগরণের ঢেউ হিসেবে আছড়ে পড়ল সেটা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন ইতিহাসবিদ ,লেখক বিশ্বেন্দু নন্দ ও অত্রি ভট্টাচার্যের যৌথ সম্পাদনায় পুঁথি “টডের তরবারি: ভদ্রবিৎতের ইসলামোফোবিয়া রাজপূত – পৌরুষের খোঁজে”৷ প্রশ্ন থেকে যায় মধ‍্যযুগে সম্প্রীতির ভারতে আধুনিক প্রাক্কালে ইসলামোফোবিয়া ঔপনিবেশিক ভারতে সহজে ধারন করে নিল কেন? ইসলামোফোবিয়া শব্দ ভারতীয় মাটিতে সহজে চাষ হল কারন ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ও হিন্দু সমাজের বর্ণবাদ৷কিছু পণ্ডিত যুক্তি দিয়েছেন যে এটিকে মুসলিম-বিরোধী বর্ণবাদের সমার্থক হিসাবে বিবেচনা করা উচিত, যেহেতু পৃথক মুসলমানদের জীবনে ইসলামোফোবিয়ার প্রভাব এবং যারা ইসলামফোবিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে তাদের মনোভাব বর্ণবাদের ফলে ঘনিষ্ঠভাবে তুলনীয়। অশোক রুদ্র -এর লেখা বই ” ব্রাম্মণ‍্য ভাবধারা ও আধুনিক হিন্দু মন” অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছেন৷বাংলায় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ শিল্পের আকারে খুবই সুক্ষ্ম ভাবে ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়ে আসছে৷যেমন বুদ্ধিজীবীদের কাছে “ভালো মুসলিম “ও “খারাপ মুসলিম” শব্দ দুটি আমাদেরকে একই ফাঁদে ফেলে দেয়।বর্তমান ভারতে আমরা রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলামোফোবিয়ার রূপ দেখেছি যেমন তিন তালাক, কোভিড কালে, গরুর জন্য মুসলমান হত্যা, প্রকাশ‍্যে গণহত্যার ডাক, গোলি মারো শালো কো স্লোগান, ট্রেনে মুসলিম পোশাক আশাক দেখে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে৷ অর্থনৈতিক ভাবে বয়কট করা, ঘরবাড়ি, মসজিদ ও দরগাহ বুলডোজ করা, কোরআন নিয়ে আপত্তিকর শব্দ ব‍্যবহার ও হিজাব ইত্যাদি নিয়ে পশ্চিমের মিডিয়ার আদলে ভারত তথা বাংলার বেশিরভাগ মিডিয়া ইসলামোফোবিয়াকে প্রচার করেছে ও প্রজেক্ট হিসেবে তৈরি করেছে দিনের পর দিন যা জনমানসে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে৷ গণহত্যা হলেও কারুর কিছু যায় আসে এই রকম চেতনাহীন বোধ তৈরি করতে পেরেছে৷

আমাদের বাংলায় ইসলামোফোবিয়া সাহিত্য থেকে রাজনীতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তরে কিভাবে বিস্তার লাভ করেছে কয়েকটি পয়েন্ট আলোচনা করা যায়৷সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ” এই কথার মধ্যে মুসলমান ধর্মের উৎসবকে বাইরে রেখে বাঙালি উৎসবের রূপ তৈরি করা হয়েছে৷ মুসলমান বাঙালি হতে পারে না এই রকম মিথ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে৷ রাজনৈতিক দিক দিয়ে কমিউনিস্ট দল থেকে তৃণমূল দল মুসলিম সমাজের নেতৃত্বহীন রেখে কেডার তৈরির মাধ্যমে আতঙ্ক করে তুলেছে৷ ইসলামোফোবিয়া এমন যে আজ পর্যন্ত কোন আমাদের রাজ‍্যে মূখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কোন রাজনৈতিক দল তোলেনি ৷ বাংলায় প্রথম মেডিক্যাল পড়ানো হত কলকাতা মাদ্রাসায় তাকে অবলুপ্ত করে রাখা হয়েছে ৷ ওয়াকফ সম্পত্তির ইনকাম ও সাচার কমিটির রিপোর্ট এখনো কার্যকারী হয় না, মুসলিম অধ‍্যুষিত এলাকায় স্কুল, কলেজ, রাস্তা ঘাট, হসপিটাল, জল পরিসেবা সব এখনো পরীকাঠামোহীন করে রাখা হয়েছে৷ বাংলার গ্ৰামে শোনা যায় এদের বাচ্চাকাচ্চা প্রচুর ভারত দখল করে নেবে ৷ এরা বড্ড বাড় বেড়ে গেছে এদের টাইট দিতে হবে ৷ এরা পাড়ায় পাকিস্তানের পতাকা উড়ে (ইসলামী পতাকা কে পাকিস্তানের পতাকা বলে অনেক সময়)৷ ঘর ভাড়া ,জায়গা বিক্রি এবং দোকান করার জন্য বাংলার বিভিন্ন জেলার শহর, ব্লকে মুসলিমদের উপর অঘোষিত ও ঘোষিত ভাবে নিষেধাজ্ঞা করা রাখা হয়েছে ৷ প্রশাসন থেকে শিক্ষক প্রত‍্যেকে আর এস এস আনুগত্য সদস্য মত ব‍্যবহার দেখা যায় ৷ বাংলায় ভারত সেবা আশ্রম, বেলুরমঠ, রামকৃষ্ণ মিশনে যে মোহন ভাগবত আসেন কখন মিটিং হয় সব গোপনে রাখা হয় ৷ অর্থাৎ একটি ধর্মীয় নাগরিকদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক কোনাঠাঁসা করা হচ্ছে এর কার ইসলামোফোবিয়ার নয় তো কি? স্কুলে কলেজে, রাস্তা ঘাটের নাম নাম মাত্র মুসলিম মনীষাদের নাম ও ফটো পাবেন এবং সাধারণত প্রত‍্যেক জেলার ডি এম সাইটে দেখবেন ঐ ওয়েবসাইট গুলোতে ঐ জেলার কোন মুসলিম সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ইতিহাস ব্রাত‍্য করে রাখা হয়েছে, এই গুলো ইসলামোফোবিয়া নয় তো কি সম্প্রীতি?

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর