এই ডাইরি যখন লিখছি তখন কিন্তু মালঞ্চের সোনালী রৌদ্রমাখা দুপুরের সেই মুহূর্তগুলি হয়তো স্মৃতির অকপটে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। কোন এক নির্জন সন্ধ্যা কিংবা দুপুর বা কোন দিনের সূর্যের বিদায়লগ্নে খুব মনে পড়ে মালঞ্চের সোনালী স্মৃতি গুলি। জানিনা মালঞ্চের সাফল্য আমাকে কোনো বাস্তব সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুই সাফল্য প্রত্যাশী করেছে নাকি নিজের শক্তি কে চিনতে শিখিয়েছে! কিন্তু এটা তো নিশ্চয়ই জানি মালঞ্চ আমার জীবনে এক বিশাল অপ্রাপ্তিকে দূর করেছিল। আর আমার জগৎটাকে আরও প্রসারিত করে দিয়েছে।
সেই নির্জন সন্ধ্যার অন্ধকার নিস্তব্ধতা ভরা সুন্দরবন থেকে জ্যোৎস্নামূখর হলদীমুখি নদীর ওপারের মেদিনীপুর। হাতির ডাক ভরা, সবুজে ঘেরা লালমাটির দেশ বাঁকুড়া থেকে প্রত্যন্ত মুর্শিদাবাদের গ্রামাঞ্চল গুলি যা এককালে সিরাজের সৈন্যদের কোলাহলে মুগ্ধ ছিল একযুগে। চিনিয়েছে সবুজ আমবাগানে ঘেরা বরেন্দ্রী উপভাষার পিঠস্থান মালদা থেকে সীমান্তবর্তী প্রাচীন জনপদ দিনাজপুরকে। আবার মালঞ্চ আমার পরিচয় করিয়েছে আমার বাংলার শহর এবং শহরতলীগুলোর সঙ্গে। ‘মালঞ্চ’ শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ যদি মোহনা হয় তবে তার বাস্তব অর্থবহ দিকটা কিন্তু আমার জীবনে কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের মালঞ্চ মিশন যে সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করেছে তার যাত্রাপথের প্রথম দিকের সাথে ছিলাম আমরা।
সত্যি মালঞ্চ তুমি মোহনা, না নদীর মোহনা নয় তুমি নানা ধরার বৈচিত্রের মোহনা, তুমি মানবের মিলনের মহামোহনা। এই মোহনার উপর ভাসমান তৈরিতে সওয়ার থাকাকালীন অনেক সুখ দুঃখে ভরা দিবা-রজনী অতিবাহিত করেছি। এখনো মনে পড়ে পরীক্ষা থেকে ফিরে মহানন্দে ডাইনিং রুমে কোলাহলপূর্ণ মধ্যাহ্নভোজনের কথা। মনে পড়ে পড়ন্ত বিকালে মালঞ্চের পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলার কথা। খুব মনে পড়ে রমজান মাসের সেহরি ইফতারের স্মৃতিলেখা। ভুলতে পারিনা মালঞ্চের সামনের মাঠে ছুটির আর ঘরে ফেরার পূর্বানন্দে নিশীথ আধাঁর কে উপেক্ষা করে রাত্রে ফুটবল খেলার কথা, আবার বর্ষণসিক্ত বিকালে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি আজও হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। সুখ দুঃখের মাঝে মালঞ্চের সহপাঠী বন্ধু ও ছোট ভাইদের ভালোবাসার কথা আজও হৃদয় অকৃত্রিম অনুভূতির সৃষ্টি করে। কোন ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সহপাঠীদের সঙ্গে সেক্রেটারি স্যারের ভয়ে খাটের তলায় লুকানোর স্মৃতি কেই বা ভুলতে পারে। সত্যিই একটা মানুষের ৬০ বছরের গড় জীবনে এমন দুই বছরের ছোট্ট জীবন এতটাই বর্ণময়, গন্ধময়, গতিশীল এবং স্মৃতিমাখা ছিল যে কারণে আমার কাছে এই জীবনটা এখনও চরম অর্থবহ। দুই বছরের এই ছোট্ট জীবনগাথা, অভিজ্ঞতা এবং অনুভবকে লিখে প্রকাশ করা আমার পক্ষে দুরূহ কাজ। জানি না অন্য সব বন্ধুরা এই সব কথাগুলো মনে করে কিনা তবে আমার খুব মনে পড়ে এই সব স্মৃতিগুলোর কথা এবং স্মৃতিগুলি যাদের স্পর্শে গড়ে উঠেছিল তাদের কথা। বিকেলবেলা খেলার পর ঘনায়মান অন্ধকারকে পাশ কাটিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে ইভিনিং টিফিন টেবিলে কত গল্প, তার অনেকটাই হয়তো এখন স্মৃতির তলদেশে বিলীন হতে বসেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে মিশনের ডাইনিং রুমের পাশ দিয়ে সাদা সন্ধিগ্ধ অবস্থায় এবং শঙ্কিত মনে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মিশন থেকে বেরিয়ে বাজারে কোন দোকানে গা ঢাকা দিয়ে খেলা দেখার কথা না বললে এই ডাইরি পূর্ণাঙ্গতা থেকে বঞ্চিত হবে। আবার কখনো কেউ কেউ ধরা পড়লে সেক্রেটারি স্যারের তাড়া এবং ধমক আজও হৃদয়ে যেন অকৃত্রিম ভয় এবং বাঁধাধরা জীবনের উন্মত্ততাকে গভীর ভাবে অবলোকন করার বার্তা নিয়ে হাজির হয়। যদিও মিশনের জীবনটা খাতা, পেন, ক্লাস এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করার গভীর অথচ ফলপ্রসূ চক্রান্ত চলত তবুও সর্বদা আমরা ছিলাম চরম স্বাধীনতাকামী।
আর এই স্বাধীনতা কিঞ্চিত পরিমাণ অর্জনের জন্য নিজেদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং চালাকিতে পারদর্শিতা আমরা সব সময় ব্যবহার করার চেষ্টা করতাম। মালঞ্চ মিশনের উচ্চ মাধ্যমিক ব্যাচের পথ চলা শুরুর তৃতীয় ব্যাচ ছিলাম আমরা। তাই সে সময় ডিসিপ্লিনের এতটা কড়াকড়ি সম্ভব হয়নি পরিকাঠামো সহ নানা কারণে। তবে আজকের মালঞ্চ মিশন পুরো রাজ্যের মধ্যে অন্যতম সবথেকে শৃংখলাবদ্ধ এবং সফল একটি মিশনের নাম। তবে সেই সময়ে আমরা এ মিশনের সাথী হতে পেরে নিজেদেরকে এখন সৌভাগ্যবান মনে করি। এর অনেকটা কারণ হলো বাঁধাধরা মিশনের জীবনকে এড়িয়ে মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের স্বাধীনতাপ্রেমি সত্ত্বাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতাম অনেক ঝুঁকি নিয়ে হলেও। তাই সে জীবন আমাদের কাছে অতোটা পীড়াদায়ক ছিল না বরং স্বাধীনতা এবং মাতৃভূমির প্রতি সবার যে অকৃত্রিম সহজাত আকর্ষণ থাকে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিল।
সত্যি এই দুনিয়াতে ভালোবাসার অন্যতম চরম প্রতিরূপ আমাদের মমতার প্রতীক মা। মা কথাটি যতগুলি শব্দের সাথে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত তার প্রতি মানুষের টান চূড়ান্তভাবে অকৃত্রিম, অনাবিল, সর্বময় এবং সর্বজনবিদিত। তা সে নিজের আম্মু ডাকা মা হোক আর মাতৃভাষা বা মাতৃভূমিই হোক। মাতৃভূমির টান গভীরভাবে আমাকে সঞ্চিত করেছিল ওই সময়। ওই দুই বছর আমাকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং গুরুত্ব বুঝতে শিখিয়েছে। এই ডাইরির শেষ ছত্রে আমি কি লিখব তার যথার্থতা ভাষারূপে উপস্থাপনে অপারগ এবং ব্যর্থ হচ্ছি। তবে মালঞ্চ যে তরী বাইতে শিখিয়েছে সেই তরী স্রোতের টানে কোন মুখী হয় সেটাই বড়ো প্রশ্ন। সেই তরী উপকূলের টানে স্নিগ্ধ নীল সমুদ্রের মায়াবী স্নেহ মাখা অথচ ব্যাঙ্গপূর্ণ ইশারাকে উপেক্ষা করে ফিরে আসে নাকি উপকূলের সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করে উজানের সাথে নীল সুউচ্চ ঢেউয়ে ভরা উত্তাল সমুদ্রের বুকে কোন এক অনিশ্চিত দিগন্তের পথে নিজেকে এবং তার এই নিরুপায় লেখককে সমর্পণ করে সেটাই এখন দেখার।
লেখক বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অফিসার, লেখাটি ২০১৫ সালে তার লেখা ডাইরীর পাতা থেকে গৃহীত