Tuesday, April 22, 2025
30 C
Kolkata

স্মরণে মননে ইবনে ইমাম: কাফেলার অন্যতম ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক


~মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস

জীবন ছোটো হয়ে আসছে৷ সাথে সাথে সময় বলে দিচ্ছে কিছু কাজ তোমাকে করতে হবে, এবং তোমাকেই করতে হবে৷ তোমার পরে এ কাজ আর কে করবে তার ঠিকও নেই , ঠিকানাও নেই৷ অতএব, এ কাজ ও এ দায়িত্ব আমি হাতে তুলে নিলাম৷
আবদুল আযীয আল আমান সময়ের আহ্বানও বুঝতেন, সময়ের গুরুত্ব এবং ভাষাও বুঝতেন৷ এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কাফেলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সময়ের ভাষা ও বাণীকে কাফেলায় লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছিলেন৷
কাফেলার সাহিত্যাসরে নিয়মিত অংশগ্রহণকারীদের প্রায় সবাইকে আমি চিনতাম কিন্তু সবার সঙ্গে আমার কথা হয়নি৷ প্রবীণদের মধ্যে কবিরুল ইসলাম, মাহমুদল হক, জালালউদ্দিন আহম্মদ , বেগম সুরাইয়া কামাল প্রমুখকে চিনতাম কিন্তু কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে৷ তবে, প্রবীণ ইবনে ইমাম, রফিকউল্লাহ সহ এডভোকেট আবদুর রফিক প্রমুখের সঙ্গে রীতিমতো ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল৷ এ মান্নাফ-আবু আতাহারের কথা তো আগেই লিখেছি৷
নবীনদের মধ্যে অনেককেই চিনতাম ঘনিষ্ঠতা না হওয়া সত্ত্বেও৷ মতিউল্লাহর নাম তো করতেই হয়৷ হাসির মল্লিক হুগলি থেকে আসত৷ মোস্তাব আলী নামে এক যুবক হাসনাবাদ থেকে আসত৷ অসাবধানবশত কারো নাম বাদও পড়তে পারে৷ মনে এলে যোগ করে দেবো৷

ইবনে ইমাম কাফেলার ঊজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক৷ নিরহঙ্কার সদাহাস্য আনন্দপ্রিয় মানুষ৷ তিনি যত বলতেন ততই শুনতে ভালো লাগত৷ তাঁর বাগ্ -ভঙ্গী ও লিখনশৈলী ছিল তাঁর একান্ত নিজস্ব৷ তাঁর ‘সরাইখানার যাত্রী’ পড়ার পর তাঁকে ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়৷ কাফেলার কল্যাণেই তাঁকে আমরা চিনেছিলাম৷ তাঁর আরো কিছু বই আছে৷ সেগুলি রচনাসমগ্র হয়ে প্রকাশিত হওয়া উচিত৷
তিনি ছিলেন লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ৷ একজন কৌতুহলী কিশোরের মতো তাঁকে আমি প্রশ্ন করতুম৷ ‘সরাইখানার যাত্রী’ শুধু পড়িনি, তার বিষয়াদিও তাঁর মুখ থেকে থেকে শুনেছিলুম৷
তিনি ইউরোপের একাধিক দেশ ও তুরস্ক ভ্রমণের কথা বলেছিলেন আমাকে৷ এ প্রসঙ্গে তাঁর স্মরণীয় উক্তি আমার আজও মনে রয়ে গেছে৷ তিনি বলেছিলেন, ঢাকা-কলকাতা-দিল্লির পুরানা মহল্লাগুলো যেমন ঘিঞ্জি বস্তির মতো তেমনি ইউরোপের বড় বড় নগরগুলোর পুরানো মহল্লাগুলিও ওই রকম৷
তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের বর্ণনা শুনে আমি খুব কৌতুক বোধ করেছিলুম৷ আসলে একটা ঘটনা ঘটেছিল৷
ওই সময়ের কিছু কাল আগে আমি একটি তুর্কি ছায়াছবির ইংরেজি ডাবিং দেখেছিলুম৷ ছবিটার নাম ছিল ‘ কনকয়ার টু এ গোল্ডেন সিটি”৷ ওই সিটিটাই ছিল ইস্তাম্বুল৷ অদ্ভুত ব্যাপার হল তাঁর বর্ণনার সঙ্গে এই ছবির বর্ণনা হুবহু মিলে গিয়েছিল৷
কাফেলা-গতির অফিস এক পর্যায়ে কলেজস্ট্রিট মার্কেটের দো’তলা থেকে ১বি জাননগর রোডে চলে এসেছিল৷ ওটা ১৯৮৬ সালের শেষ ও ‘৮৭ সালের দিককার কথা৷ আমান সাহেব আমাকে গতি-কাফেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে নিয়ে ওই অফিসে নিয়মিত করে নেন৷ আমার সহকর্মী হয়েছিল রফিকউল্লাহ সাহেবের দুই ছেলে রবিউল করিম ও ফিরোজ জুলফিকার৷ ওরা দুজনেই বয়সে আমার ছোট ছিল৷ আমাকে দাদা ডাকত৷
জাননগরের কাফেলা-গতি অফিস অনেক বেশি মুক্ত পরিবেশে থাকাতে সাহিত্যসেবী-কবিতাপ্রেমিকরা ইচ্ছামতো যাওয়া-আসা করতে পারতেন৷ প্রবীণ-নবীন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকত অফিসের দ্বার৷ রবিবাসরীয় সাহিত্যসভা তখন ওখানেই বসত৷
ইবনে ইমাম সাহেব প্রায়ই আসতেন৷ উনি এলে আমার খুব আনন্দ হত৷ তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু জানতে পারতাম৷
পার্ক সার্কাসের পার্ল রোডে থাকতেন তিনি৷ কথা প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম মনস্বী আবু সয়ীদ আইয়ূব ও তিনি একই বিল্ডিংয়ের উপর নিচের ফ্ল্যাটে থাকতেন৷ সেয়দ মুজতবা আলী আইয়ূবের সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন৷ তাঁদের সম্পর্কে অনেক কথা আমি অনেক কথা জানতে পেরেছিলুম৷ সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবু সয়ীদ আইয়ূবকে আমি দেখিনি; তাঁদের রচনাবলী পড়েছি৷ তাঁদের সাহিত্য নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছা পোষণ করি৷
আমার অগোছালো ছন্নছাড়া জীবনটাকে নিয়ে আজীবন মুসাফিরি জীবন কাটিয়ে এলুম৷ সে বড় দ্বন্দ্বমধুর জীবন৷ এই তিন ব্যক্তির জীবন ছিল আরো দ্বন্দ্বমধুর৷ তাঁদের জীবনবৃক্ষের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে অমূল্য জীবনধারার অশ্রুতপূর্ব কাহিনী৷ কিছু রয়েছে তাঁদের জীবনপত্রে, কিছু রয়েছে তাঁদের রচনায়৷
ইবনে ইমাম সাহেবকে আমি চাচাজী সম্বোধন করে কথা বলতুম৷ আমার প্রতি তাঁর আচরণ ছিল অত্যন্ত স্নেহমধুর৷ তাঁর মৌখিক ভাষা ও বাকরীতির একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল৷ উচ্চশিক্ষিত-স্বশিক্ষিত-বিনয়ী ও সুভদ্র মানুষদের এটাই বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে৷
গতি-কাফেলায় স্টাফ হয়ে বেশিদিন থাকা হয়নি আমার৷ কিন্তু আজীবন ( ১৯৮১—১৯৯৩ ) সম্পর্ক রক্ষা করে আর নিয়মিত লিখে এসেছি৷
ইমাম চাচাজীর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসের দিকে৷ ওই বছর নভেম্বর মাসে ঢাকায় যাওয়া আর ফেরার মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি৷
পরে জানতে পারি তিনি ইহলোকে আর নেই৷

Hot this week

আইপিএস নুরুল হুদার পদত্যাগ, ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে রাজনীতিতে প্রবেশ

আইপিএস অফিসার নুরুল হুদা ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে...

হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা…! ...

হঠাৎ করে বুকে ব্যথা হওয়ায় তৎকাল কমান্ড হাসপাতাল ভর্তি...

মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লের জৈন মন্দির ভাঙা ঘিরে বিতর্ক, রাস্তায় নেমে নীরব প্রতিবাদে হাজারো মানুষ

মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লে এলাকায় অবস্থিত প্রায় ৯০ বছরের প্রাচীন...

অবশেষে আইনি মতামত নিয়ে রাজ্যকে যোগ্য অযোগ্য তালিকা পাঠাচ্ছে এসএসসি

ফের পথে নামলেন চাকরি হারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মানববন্ধন করে এসএসসি...

বামেদের ব্রিগেড ‘ফ্লপ শো’ বললেন তৃণমূল নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার

গত রোববার ছুটির দিনে বামেদের ডাকে আয়োজিত হলো বিশাল...

Topics

আইপিএস নুরুল হুদার পদত্যাগ, ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে রাজনীতিতে প্রবেশ

আইপিএস অফিসার নুরুল হুদা ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে...

হঠাৎ করেই বুকে ব্যথা…! ...

হঠাৎ করে বুকে ব্যথা হওয়ায় তৎকাল কমান্ড হাসপাতাল ভর্তি...

অবশেষে আইনি মতামত নিয়ে রাজ্যকে যোগ্য অযোগ্য তালিকা পাঠাচ্ছে এসএসসি

ফের পথে নামলেন চাকরি হারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মানববন্ধন করে এসএসসি...

বামেদের ব্রিগেড ‘ফ্লপ শো’ বললেন তৃণমূল নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার

গত রোববার ছুটির দিনে বামেদের ডাকে আয়োজিত হলো বিশাল...

জয় শ্রী রাম স্লোগান না দেওয়ায় মুসলিম কিশোরকে ভাঙ্গা কাঁচের বোতল দিয়ে বেধড়ক মার

উত্তরপ্রদেশের কানপুর গ্রামীণ এলাকার মহারাজপুর থানার অধীন সরসৌল অঞ্চলে...

Related Articles

Popular Categories