
শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মচেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক ও সমন্বয়মূলক। তিনি বিভিন্ন ধর্মের উপাসনাগৃহে গিয়ে আরাধনা করতেন। একবার মুসলিমপাড়ার মসজিদের মৌলবী মোছন মোল্লা গুরুতর অসুস্থ থাকার খবর জানতে পেরে গ্রামবাসীদের নির্দেশ দেন তারা যাতে কবিরাজ নিয়ে মৌলবীর বাড়িতে তার চিকিৎসার জন্যে যান। এ ঘটনায় মুসলিম সম্প্রদায় শ্রীরামকৃষ্ণকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে।
তাঁর সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। প্রথমদিকে তিনিও প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যেমন রানী রাসমণি নিম্নবর্ণের হওয়ায় দক্ষিণেশ্বরের প্রসাদ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকেই তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে নিন্দা করতে শুরু করেন ও বারবার উল্লেখ করতেন যে, প্রকৃত ধর্ম অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সহিষ্ণুতা শেখায়।
শ্রীরামকৃষ্ণকে শুধু আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে নয়, একজন সমাজ-সংস্কারক হিসেবেও দেখা যায়। তিনি প্রচলিত ধর্মীয় মতবিরোধগুলোকে দূর করে ঐক্য ও সমন্বয়ের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর প্রভাব সমসাময়িক অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীদের সংকীর্ণতা দূর করতে সাহায্য করেছে।
উনিশ শতকের নবজাগরণের বহু মনীষী—বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ—তাঁর সহজ, আন্তরিক ও মানবিক চেতনায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর বহুত্ববাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অলৌকিকতার আশ্রয় নেননি, বরং মানবতাবাদ ও ধর্মীয় সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও জাতি-ধর্মের বিভাজিত সমাজের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।