
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৩২ ভারতীয়কে হাতে-পায়ে পায়ে শিকল বেঁধে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর “ডাবল ইঞ্জিন” সরকারের “ভাইব্র্যান্ট গুজরাট”-এর প্রচারিত সাফল্যের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এই তালিকায় গুজরাটিদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো, যা রাজ্যটির অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নীতিগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। নিচে এই সংকটের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো:

১. বেআইনি অভিবাসনের পেছনের অর্থনৈতিক সংকট
মজুরি বৈষম্য: গুজরাটের একজন অদক্ষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি মাত্র ৩৭৫ টাকা, যা কেরালার (৮৩৬ টাকা) অর্ধেকেরও কম। এমনকি কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক আয় ২৪২ টাকা—যা জাতীয় স্তরে সর্বনিম্ন।
শিল্পনীতির ব্যর্থতা: ২০০১ সাল থেকে কর্পোরেট-কেন্দ্রিক মেগা প্রকল্পে জোর দেওয়া হলেও তা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ। ২০০৪-২০১৪ সালের মধ্যে ৬০,০০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে, যা একসময় গুজরাটের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল।
২. মানবিক বিপর্যয়: সীমান্তে প্রাণহানির করুণ ঘটনাবলি

দিনগুচা ট্র্যাজেডি (২০২২): গুজরাটের দিনগুচা গ্রামের বাসিন্দা জগদীশ প্যাটেল ও তার পরিবার কানাডা-মার্কিন সীমান্তে প্রচণ্ড ঠান্ডায় হিমায়িত হয়ে প্রাণ হারান। এই ঘটনা “ডনকি রুট”-এর বিপদকে সামনে এনেছে, যেখানে দালালরা প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাঠায়।
২০২৩ সালের অন্যান্য ঘটনা: মেহসানার প্রবীণ চৌধুরী ও তার তিন জন পরিবারের সদস্য নজরদারি এড়িয়ে কানাডা থেকে সেইন্ট নৌপথে লরেন্স নদী পেরোনোর সময়ে নৌডুবিতে প্রান হারান। ঐ একই বছরে গুজরাটের ব্রিজ কুমার যাদব সান দিয়াগো ও টিজুয়ানা পয়েন্টে মেক্সিকো-মার্কিন সীমানার দেয়াল টপকাতে গিয়ে মৃত্যু হয়—এসবই স্বল্প পয়সার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মার্কিন মুলুকে মানব পাচার চক্রের শিকার হওয়ার প্রমাণ ।
৩. পরিসংখ্যানে বৈপরীত্য: জিডিপি বনাম মানব উন্নয়ন: গুজরাটের মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ (১,৮১,৯৬৩ টাকা) হলেও রাষ্ট্রসংঘের মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি ইনডেক্সে (MPI) রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও পিছিয়ে ।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা: ৩৮% গুজরাতি পর্যাপ্ত খাদ্য পায় না, যা এত উন্নয়নের দাবিদার রাজ্যের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ।

৪. “ভাইব্র্যান্ট গুজরাট”-এর নামে মিথ্যা, সাজানো গল্প কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা: আদানি-অম্বানি গোষ্ঠীকে নামমাত্র মূল্যে জমি পাইয়ে দেওয়া এবং কর ছাড়দেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সম্পুর্ণ রূপে ব্যার্থ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বাজেট কাটছাঁটের ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাট পিছিয়ে পড়ছে।
শ্রম আইনের অবহেলা: ৭৪% শ্রমিক কোনো লিখিত চুক্তি ছাড়া কাজ করেন, যা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। স্থায়ী চাকরির গড় বেতনও অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় কম ।
৫. রাজনৈতিক প্রচার বনাম বাস্তবতা
ডাবল ইঞ্জিন সরকারের ব্যর্থতা: “গুজরাট মডেল”-এর নামে শিল্পায়নের জোয়ারে MSME সেক্টর ধ্বংস হয়েছে, যা একসময় ৮৫% কর্মসংস্থানের উৎস ছিল। বর্তমানে মেগা প্রকল্পে প্রতি ৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগে মাত্র ১টি চাকরি সৃষ্টি হয়।
সামাজিক অস্থিরতা: ২০২৩ সালে গুজরাট পুলিশ ১৪টি অভিবাসন দালালের বিরুদ্ধে FIR দায়ের করে, যা নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতাকে প্রকাশ করে।
৬. উন্নয়নের নামে শোষণের মডেল

গুজরাট মডেল আসলে কর্পোরেট লুটেরাদের স্বর্গরাজ্য, যেখানে শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, কাজের নিরাপত্তা বা সামাজিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। “ডাবল ইঞ্জিন” সরকারের দাবি প্রকৃতপক্ষে একটি “ডাবল স্ট্যান্ডার্ড”-এর প্রতিফলন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুর্দশা উন্নয়নের জাঁকজমকে ঢাকা পড়ে। সামরিক বিমানে গুজরাটিদের ফেরত আসা শুধু জাতীয় লজ্জাই নয়, এটি একটি ব্যবস্থাগত ব্যর্থতার দলিল ।
তথ্যসূত্র: মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রিপোর্ট, গুজরাত সরকারের শ্রম পরিসংখ্যান, এবং স্বাধীন গবেষণা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংকলিত।