
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক শুল্ক শিথিলতার পর সারা পৃথিবীব্যাপী প্রযুক্তির সাপ্লাই চেইন নিয়ে দ্বন্দ্বমূলক প্রতিযোগিতার উত্তাপ কমার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মন্তব্যে ফের আলোচনায় এসেছে তার “অর্থনৈতিক দেশপ্রেম” এর ধারণা। এবারের প্রতিপক্ষ চীন নয়, বরং অ্যাপলের ভারত-কেন্দ্রিক উৎপাদন পরিকল্পনা।
অ্যাপলের সিইও টিম কুক ২ রা মে ঘোষণা করেন যে এই বছরের এপ্রিল-জুন কোয়ার্টারে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ আইফোন ভারতেই তৈরি হবে। চীনের উপরে নির্ভরতা কমানো ও সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র আনতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গত ১৫ ই মে কাতারের দোহায় এক ব্যবসায়িক সম্মেলনে ট্রাম্প সর্বসমক্ষে সরাসরি আপেলের সিইও টিম কুকের কড়া সমালোচনা করে বলেন “টিম, তুমি আমার বন্ধু, কিন্তু ভারতে আইফোন উৎপাদন করছো? আমি চাই না তোমরা সেখানে বিনিয়োগ করো। ভারত উচ্চমাত্রায় শুল্ক নেয়, সেখানে বিক্রি করা কঠিন।” তিনি আরও যোগ করেন, “ভারত আমাদের বিনাশুল্কে বাণিজ্যের চুক্তি দিয়েছে, কিন্তু অ্যাপলকে সেখানে উৎপাদনের অনুমতি আমি দেব না।”
অ্যাপলের ভারতীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য, অ্যাপল তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি। PLI স্কিমের আওতায় ২০২০ সাল থেকেই অ্যাপলে সহ অন্যান্য কোম্পানীগুলি ভারতকে স্মার্টফোন উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ হাব করে তুলেছে। PLI স্কিমের মাধ্যমে তিন বছরে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সুবিধা পাচ্ছে অ্যাপল প্রতিষ্ঠানটি। ফক্সকন, উইস্ট্রন (বর্তমানে টাটা গ্রুপের মালিকানায়) ও পেগাট্রনের মতো পার্টনারদের মাধ্যমে আইফোনের প্রিমিয়াম মডেলসহ সমস্ত পণ্য এখন ভারতেই তৈরি হচ্ছে।
আসলে ট্রাম্প চান অ্যাপল শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সব আইফোন উৎপাদন করুক। কিন্তু ভারতে অ্যাসেম্বলিং খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশী কম। সুতরাং এ নীতি রাতারাতি বদলানো একেবারই সম্ভব নয়।
মার্কিন সংবাদ সংস্থা নিউইয়র্ক পোস্টের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফক্সকন কোম্পানিকে প্রায় ৪৩৩ মিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্ট তৈরি করতে অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার। আশা করা হচ্ছে ২০২৭ সালের মধ্যেই সেখানে পুরোদমে উৎপাদন শুরু করার সম্ভব হবে।
ভারত সরকার মনে করছে, শুধুমাত্র শুল্ক নিয়ে দ্বন্দ্ব নয়, বরং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মত প্রতিশ্রুতি ভরা স্কীম ও আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের বাণিজ্য সম্ভাবনাই গ্লোবাল প্রযুক্তির কোম্পানিগুলোকে ভারতে তাদের পণ্য উৎপাদন করতে আকর্ষণ করছে। সর্বসমক্ষে ট্রাম্প টিম কুকের কড়া সমালোচনা করা সত্ত্বেও অ্যাপল তাদের পরিকল্পনায় এতটুকু পরিবর্তন করেনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈশ্বিক উৎপাদন পুনর্বিন্যাসে ভারত এখন প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ন প্রতিযোগী, যার ভিত্তি তৈরি হয়েছে নীতিগত স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ।

মার্কিন-চীন বাণিজ্য টানাপোড়েনের পাঁকে পড়ে অ্যাপলের ভারতমুখী হওয়াকে বিশেষ কৌশলগত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছে বিশ্লেষকরা। ভারতের PLI স্কিম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকের তুলনায় ভারতের শ্রমিকের মজুরি অনেক কম থাকায় ভারতে কারখানা গড়ার প্রতি অ্যাপল সহ অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির আকর্ষণ বাড়ছে। ট্রাম্পের এধরনের মন্তব্যের পেছনের আসল কারণ হিসাবে আমেরিকায় অতিজাতীয়তাবাদী ভাবধারা উস্কে নিজের সিংহাসন বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টাই জলের মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।