Saturday, April 19, 2025
32 C
Kolkata

শিক্ষা: আমাদের অবস্থা ও অবস্থান

~মুদাসসির নিয়াজ

পবিত্র কুরআনে সর্বপ্রথম যে শব্দ নাযিল হয়, তা হল ইকরা। অর্থাৎ পড়ো। অথচ বাস্তবে দেখা যায় আমরা মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছি। এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে তপশিলী জাতি, উপজাতি, আদিবাসীদের থেকেও শিক্ষাগত দিক থেকে আমরা অনগ্রসর। আবার আমাদের মুসলিম সমাজে যারা পড়াশোনায় এগিয়ে রয়েছেন বা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন, তাদের একটা বড় অংশ ইসলাম-বিমুখ। একাংশ আবার নিজেদেরকে সেক্যুলার বলে প্রমাণ করতে সদা তৎপর। তারা অমুসলিম সমাজের কাছে প্রিয়পাত্র হতে চান বা তাদের গুডবুকে থাকতে চান। তাই সজ্ঞানে তারা মুসলমান সমাজ তথা ইসলামের সঙ্গে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এলিট মুসলিম সমাজের সিংহভাগই খাদ্য, পোশাক, চালচলন, উৎসব, অনুষ্ঠানে অমুসলিম সংস্কৃতির অনুসরণ, অনুকরণেই তৃপ্তি বোধ করেন। পাশাপাশি মুসলিম সমাজের মূলস্রোতের সংস্রব এড়িয়ে চলতে সচেষ্ট থাকেন। সাধারণ মুসলমানদেরকে তারা অস্পৃশ্য অচ্ছুত ভাবেন।

উল্লেখ্য, তামাম সৃষ্টিকুলের মধ্যে বিশেষভাবে মানুষকেই আল্লাহ তাআলা জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দান করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে তেমনি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সফলতা সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, উচিৎ-অনুচিত, হারাম-হালাল, জায়েজ-নাজায়েজ ইত্যাদি ফারাক করতে পারে শিক্ষা বা জ্ঞানের কারণেই। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এই যোগ্যতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই। তাদের ইলম হাসিলের কোনও প্রয়োজন নেই।
পশুপাখি, জীবজন্তুদের জীবন ধারণের জন্য সহজাত বোধ ও প্রবণতা, খাদ্য, আত্মরক্ষা, বংশবিস্তার ইত্যাদি যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তাদের জন্য করে দিয়েছেন।

পক্ষান্তরে মানুষ নিজেদের তাগিদেই শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং আহরিত জ্ঞানকে বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন মাফিক প্রয়োগ করে। শিক্ষার মাধ্যমে অজানাকে জানার কৌতুহল একমাত্র মানুষেরই থাকে। জীবজন্তু, পশুপাখিরা এই প্রয়োজন বোধ করে না। কারণ তাদের জীবনবৃত্ত বা তাদের পৃথিবী খুব বেশি বিস্তৃত নয়, তাদের জগত সীমাবদ্ধ।

শিক্ষা মূলত দুই প্রকার: জাগতিক শিক্ষা ও দ্বীনী শিক্ষা। পার্থিব প্রয়োজনে মানুষকে প্রথাগত বা পুঁথিগত শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় এবং সেখানকার সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করতে হয়। এই শিক্ষা মানুষের কেরিয়ার তৈরি করে বা কর্মজগতে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক। পাশাপাশি প্রথাগত শিক্ষা মানুষের মৌলিক জ্ঞান বৃদ্ধি করে। তার স্বতন্ত্র সামাজিক পরিচিতি তৈরি করে। এককথায় বলতে গেলে মানুষের জাগতিক প্রয়োজন পূরণের উপযোগী জ্ঞান ও শিক্ষাই হল জাগতিক শিক্ষা। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভের জন্য প্রয়োজন দ্বীনী শিক্ষা। তবে প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করাটা বেশ কঠিন। অর্থাৎ জাগতিক শিক্ষা হল দ্বীনী শিক্ষার সহায়ক বা পরিপূরক। তাই প্রকৃত মুসলমান হতে হলে উভয় প্রকার শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনই আবশ্যিক।

জাগতিক শিক্ষা অর্জনের জন্য পঞ্চেন্দ্রিয় খুব বেশি জরুরি। কিন্তু দ্বীনী শিক্ষা অর্জনের জন্য লাগে মূলত ক্কলব বা অন্তরের উপলব্ধি। তবে উভয় ক্ষেত্রেই লাগে অধ্যবসায়। স্কুল কলেজের সিলেবাসে যেসব বইপত্র পড়তে হয়, সেগুলো আমরা কেউই খুব ভাল বুঝি না। বোঝার কথাও নয়। ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি পড়ার ক্ষেত্রে প্রতি পদে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের গাইড দরকার হয়। তাতেও প্রয়োজন পূরণ না হলে গৃহশিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হয়। তারপরেও মানে বই, সহায়ক বই, কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক ইত্যাদির সহায়তা নিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু অজুহাত দেখাই না যে, আমি ইংরেজি বুঝি না, ইংরেজি আমাদের মাতৃভাষা নয় ইত্যাদি। আমরা বলি না যে, বীজগণিত, পাটিগণিত, পরিমিতি, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি ইত্যাদি এতসব বোঝা সম্ভব নয়। বরং যাতে এসব খটমট বিষয় ভালো করে বুঝে পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করতে পারি বা ভাল রেজাল্ট করতে পারি, সেজন্য প্রয়াজনে একাধিক টিউটর নিই। জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞানের নানাবিধ শাখায় পারদর্শী হওয়ার জন্য আমরা কমবেশি টিউটর নিই। প্রত্নতাত্ত্বিক যুগ, প্রাচীন প্রস্তর যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ থেকে শুরু করে ভারতের ইতিহাস, আমেরিকার ইতিহাস, ইউরোপের ইতিহাস প্রভৃতি অবলীলায় পড়ি এবং পরীক্ষা দিই। সব সাবজেক্টের ব্যাপারেই একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা নেই, কোথাও আপত্তি বা অজুহাত নেই।

COLLAGE OF MUSLIMS SCIENTISTS

কিন্তু দ্বীনী শিক্ষার ক্ষেত্রেই আমাদের যত গাফিলতি বা উদাসীনতা দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রথম অজুহাত হল আরবি আমাদের মাতৃভাষা নয়। তাই আমাদের পক্ষে কুরআন বুঝে পড়া চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সহ প্রায় সমস্ত ভাষাতেই এখন কুরআনের তরজমা বা অনুবাদ সহজলভ্য হয়ে গেছে। শুধু আভিধানিক অর্থ বা মানেই নয়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সহ কুরআনের বঙ্গানুবাদ রয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষায় কয়েক ডজন মুফাসসীর তরজমা কুরআন লিখেছেন। তবু আমরা এখনও কুরআন থেকে গাফেল বা মুখ ফিরিয়ে রয়েছি।

অথচ আমাদের কাছে ইংরেজিতে লেখা সরকারি কোনো কাগজ না চিঠিপত্র এলে, পাড়ায় ইংরেজি জানেন বোঝেন এমন লোকের কাছে যাই এবং পুরো বিষয়টা ভালভাবে বুঝে নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হই।
এছাড়াও ঘর সংসার করতে গেলে বা দেশের নাগরিক হিসেবে থাকতে গেলে সরকারি কত কিছু বিষয়ে জ্ঞান রাখি। অশিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষদেরকেও এগুলো বুঝতে হয় এবং সেইমতো কাগজপত্র করাতে হয়। যেমন রেশন কার্ড, আধার কার্ড, প্যানকার্ড, ইলেকট্রিক বিল, দলিল, পর্চা, খতিয়ান, মিউটেশন, ইনকাম ট্যাক্স, সেল ট্যাক্স, ব্যাঙ্কের কাগজপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, অনলাইন ফর্মফিলাপ, একের সঙ্গে অন্যটার লিঙ্ক করানো, চিকিৎসার জন্য নানারকম পরীক্ষা বা টেস্ট করানো ইত্যাদি কতকিছু করতে হয় ও জানতে হয়। এগুলো সব কি আমরা সবাই বুঝি। মোটেই নয়। কিন্তু যে বা যারা বোঝে, আমরা তাদের কাছে ছুটে যাই।

কিন্তু কুরআন হাদীস বোঝার জন্য আমরা কি কারও দ্বারস্থ হই, বা কারো কাছে ছুটে যাই। আদৌ নয়। আমরা এর প্রয়োজনই বোধ করি না। অথচ কুরআনকে নিজের ভাষায় বোঝা এবং সেই মতো জীবনের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, রাসূল সা. এর দেখানো পথে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয বা আবশ্যিক।

পক্ষান্তরে যা মানুষকে কুফরি ও ইলহাদের দিকে টেনে নিয়ে যায় তা চর্চা করা হারাম। যেমন ইসলামবিরোধী মতবাদ, মতাদর্শ, দর্শন, অশ্লীল ও কুফরী সাহিত্য ইত্যাদি। কিন্তু পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জন ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ ও কাম্য। তাই প্রথাগত শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শনকে অনৈসলামিক মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের ফলে শিক্ষায় নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। যা অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য এই সব দর্শন ও অনৈসলামিক শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই।

অনেকে মনে করেন, স্কুল কলেজের শিক্ষাই যথেষ্ট। ধর্মীয় শিক্ষা বা আধ্যাত্মিকতার কোনো প্রয়োজন নেই। এই শিক্ষা নাকি মানুষকে ব্যাকওয়ার্ড করে রাখে। কিন্তু তাই যদি হত, তাহলে শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বা শিক্ষায় আমরা এত অগ্রসর হওয়ার পরেও কেন মানবতার সংকট, নৈতিকতার অবক্ষয়, মূল্যবোধের মহামারী তথা মনুষ্যত্বের মন্বন্তর দেখা দিচ্ছে? কেন দেশে বৃদ্ধাশ্রম বাড়ছে? কেন দুর্নীতি লাগামছাড়া? কেন মদ, জুয়া, সাটটার এত রমরমা? কেন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, পরকীয়া, সমকামিতা, বহুগামিতা, লিভ টুগেদার, ধর্ষণ, বধূ হত্যা, নারী নির্যাতনের, গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা আকছার ঘটছে?

বৃদ্ধাশ্রমে তো আম আদমি থাকে না, অল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষরদের প্রিয়জনেরা থাকে না; এই আশ্রমে থাকেন এলিট লোকদের জন্মদাতা বাবা-মায়েরা। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, অফিসাররা তো আর নিরক্ষর বা অশিক্ষিত নন। তাঁরা যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন। তারপরেও চেয়ারে বসে ঘুস নেন, স্বজন পোষণ করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, উপযুক্ত লোককে পরিষেবা না দিয়ে বঞ্চিত করেন এবং অনুপযুক্ত লোককে অর্থের বিনিময়ে পাইয়ে দেন। সমাজের সবক্ষেত্রে এই দুর্নীতির অবাধ গতায়াত। লিভ টুগেদার তো অল্প শিক্ষিতরা করেন না। এত শিক্ষা অর্জনের পরেও কেন তাদের নৈতিকতা, মানবিকতার ঘাটতি? অথচ চাঁদের হাটে এরাই আবার গর্বভরে দাবি করেন, তাঁরা হিন্দু-মুসলিম নন, তাঁরা মানবধর্মে বিশ্বাসী। এ কেমন মানবধর্ম — তা বোধে আসে না। তাই প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনী শিক্ষা থাকলে নৈতিকতা, মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, বিবেক, চিন্তা চেতনার নব উন্মেষ ঘটে। উভয় প্রকার শিক্ষা ও জ্ঞান আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। প্রথাগত শিক্ষা আমাদেরকে দুনিয়ায় সফলতা দিতে পারে, কিন্তু দ্বীনি শিক্ষা বা ঐশী জ্ঞান আখেরাতেও সফলতা এনে দেয়। তাই দু রকম শিক্ষাই সমান্তরাল ভাবে জরুরি।

Hot this week

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

চাকরিহারা শিক্ষকদের লড়াইকে সংহতি না জানিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উক্তি “আমায় রাজনীতিতে জড়াবেন না”

কলকাতা: রাজ্যে চাকরি বাতিলের ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সুপ্রিম...

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে চলন্ত বাসে আগুন! জানালা ভেঙে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর ঘটে গেল এক...

শোয়েবকে খুন করে, তার ফিরে আসার দোয়া করলেন মৌলানাযা দেখে রীতিমতো শিউরে উঠে মহারাষ্ট্রের পুলিশ।

হাড়হিম হয়ে যাওয়া এক নারকীয় হত্যার সাক্ষী থাকলো মহারাষ্ট্র।...

Topics

আজ মুর্শিদাবাদে রাজ্যপাল ও জাতীয় মহিলা কমিশন

আজ, শনিবার, প্রশাসনিক ও সামাজিক দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ...

দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে চলন্ত বাসে আগুন! জানালা ভেঙে প্রাণে বাঁচলেন যাত্রীরা

বৃহস্পতিবার রাতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর ঘটে গেল এক...

গাজায় আবারও রক্তঝরা দিন, খান ইউনুসে একই পরিবারের ১৩ জন নিহত

গাজায় খান ইউনুস এলাকায় ইসরায়েলের একটি বিমান হামলায় একই...

পার্কস্ট্রিটে ফের আগুন! কুইন্স ম্যানসনের বহুতলে আতঙ্ক, কালো ধোঁয়ায় ঢাকল মিষ্টির দোকান

পার্কস্ট্রিটে ফের আগুন! কুইন্স ম্যানসনের বহুতলে আতঙ্ক, কালো ধোঁয়ায়...

Related Articles

Popular Categories