স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকা ও বর্তমান ভারতের পরিস্থিতি জানুন

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20200815-WA0100

এনবিটিভি ডেস্ক: দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের ভূমিকা ও বর্তমান ভারতে তাদের অবস্থান
১৭৫৭ সালে পলাশীর আমবাগানে ব্রিটিশের সঙ্গে সিরাজের লড়াই মুসলিম সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করে । যে বিশ্বাসঘাতক বেইমানরা ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করে সিরাজের পরাজয় ঘটিয়াছিল বা ভারতকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেবার বন্দোবস্ত করেছিল, তাদের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে স্মরণীয় জগত শেট, বাবু কৃষ্ণদেব, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, মীর জাফর আলি, কান্তমুদি, নন্দকুমার গোবিন্দ সিং প্রমুখ । স্কুলের সরকারী বই এ শুধু মীর জাফরের নাম পাওয়া যায় । কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় ” জগত শেট, বাবু কৃষ্ণদেব, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ,কান্তমুদি, নন্দকুমার গোবিন্দ সিং এদের নাম নেই।

নিরানব্বই বছর ধরে চলতে থাকা মুসলিমদের বিক্ষিপ্ত আন্দোলন যখন ১৮৫৭ সালে সর্বভারতীয় মহাবিদ্রোহের রুপ নিল । তখন ঐতিহাসিকরা ভন্ডামী করে নাম দিলো ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ । এই বিদ্রোহ প্রধানত মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত ছিল।
১৮৫৭ সালের বিপ্লব দমন করার পর পাইকারি ভাবে মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চলতে থাকে । অবশ্য বিংশ শতাব্দীতে পুরোপুরি ভাবে হিন্দু জাতিও যখন ব্রিটিশ বিরোধী হয়ে উঠলো তখন হিন্দু নেতা নেত্রীদের ভাগ্যেও দীপান্তর ও ফাঁসির শাস্তি নেমে এসেছিল । এর আগে কোন হিন্দু নেতার কোন শাস্তি হয়নি, তারা কোন বিদ্রোহ করে নি করলেও তা সামন্য কিঞ্চিত ।
১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ এবং ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা পর্যন্ত যেসব মুসলিম বিপ্লবী নেতা নেত্রীদের জেল দীপান্তর ও ফাঁসি হয়েছে তাদের নাম স্কুল কলেজের পাঠ্য ইতিহাস বই এ পুরোপুরি গোপন রাখা হয়েছে ।
একথা যদিও নির্ঘাত সত্য তবুও অনেক দালাল ঐতিহাসিক এড়িয়ে গিয়েছেন যে, মুসলিম বিপ্লবীদের শুধু জেল ফাঁসি হয়নি, কোট কোটি ক্ষেত্রে তাদের জরিমানা হয়েছে এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কেড়ে নিলাম করে ইংরেজরা অর্থ জোগাড় করেছে । যদিও ব্রিটিশ শাসনে যত রাস্তাঘাট, ব্রীজ, রেলপথ, টেলি ও ডাক ব্যাবস্থা ইত্যাদি হয়েছে তার বেশীর ভাগ খরচা মুসলিম সমাজ থেকেই প্রাপ্ত ।
দুশো বছর রাজত্ব করে ভাগ্যান্বেষণে আগত ব্রিটিশরা যদি দরিদ্র থেকে ধনী হতে পারে তাহলে পৌনে এক হাজার বছর রাজত্ব করার পর মুসলমান জাতি যে সকল সম্রদায়ের চেয়ে ধনী ছিলো তা ঐতিহাসিক সত্য।
মুসলিমদের জমি, সম্পত্তি যেমন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সরকারী বেসরকারি চাকরি থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালকে যদি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ বছর ধরা হয় তাহলে ১৭৫৭ তে পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলার পতনই তার সূত্রপাত।
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও নোংরা রাজনীতি ফলস্বরূপ সিরাজদৌলাকে নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হতে হয় । সুতরাং আধুনিক ইতিহাস গবেষকদের কাছে নবাব সিরাজই স্বাধীনতা আন্দোলনের উল্লেখ যোগ্য প্রথম শহীদ।
১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল অর্থাত ১৯০ বছরের সুদীর্ঘ মুসলিম আন্দোলনের জেলখাটা ও রক্ত দেওয়া কেমন করে বেমালুম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল সেটা ভয়াবহ বিস্ময়কর ব্যাপার।
কলকাতা সিটি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং রবীন্দ্রভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাষক, যিনি নিজে এক জন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতক্ষ্য সংগ্রামী ছিলেন। শ্রীশান্তিময় রায় লিখেছেন ” স্কুল কলেজের শিক্ষকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘ভারতীয় মুসলমানদের ভূমিকা’ বিষয়ে বিরাট অজ্ঞাতা দেখি । আমাদের সমগ্র প্রজন্মই খ্যাতনামা ব্যাক্তিদের লেখা ডাহা মিথ্যা ও ভুল ইতিহাস পাঠ করে বড়ো হয়েছে । মিথ্যা ইতিহাস রচনা একটি প্রাচিন শিল্পকলা যা আজও বহু প্রতিভা সম্পন্ন ব্যাক্তি প্রয়োগ করে থাকেন । ”
শ্রী শান্তিময় রায়ের লেখা ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান’ বইটিতে পন্ডিত শ্রী পি সি যোশীর ভূমিকা লেখা আছে । তার একটি বাক্য এখানে তুলে ধরছি – ” সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাধারন সংগ্রামে কিছু ‘হিন্দু’ ইতিহাসবিদদের মুসলমানদের অবদান উপেক্ষা করা বা তার ভূল ব্যাখ্যা শান্তিময় রায়কে বিচলিত করে, সত্য উদ্ঘাটনে অনুপ্রাণিত করে “।
অধ্যাপক শান্তিময় রায় আরো লিখেছেন, ” আসলে ব্রিটিশরাই তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য তাদের ওহাবী বলতো যেমন তারা পরবর্তী কালে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে বলতো ”
হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর পুত্র মহম্মদ মহসান দুই উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্ব যাঁরা ব্রিটিশ বিতাড়নে বা সংগঠন পরিচালনায় শান্তি ও আরামকে ত্যাগ করে কষ্টের পথে চলতে চলতে মৃর্ত্যু পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছেন ।
“মুসলিম বিপ্লবীদের লড়াই ভারতের আদিমতম এবং সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী ও অধিক ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই গুলির মধ্য অন্যতম “
“মুসলিম পরিচালিত বিপ্লব গুলিকে দালাল ঐতিহাসিকরা ইংরেজদের ঈঙ্গিতে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বলে চালাতে চেয়েছেন । কারন ইংরেজদে রপদলেহী জমিদার, তাদের সমর্থক ও সংরক্ষকদের ঐ বিপ্লবীরা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়ে ছিলেন । সুতরাং জমিদার, রাজা, মহারাজা ও বাবু সমাজ এটাকে হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াই বলে চালাতে চেয়েছিলেন। ”
আশি হাজার সমর্থক নিয়ে যিনি সগৌরবে বিপ্লব পরিচালনা করেছিলেন তিনি বিপ্লবী মহসিন । ( তিনি ছোট থেকে খুব দুধ খেতে ভালোবাসতেন বলে তঁকে ‘দুধু’ বা ‘দুদু’ বলা হতো । শান্তিময় রায় লিখেছেন তিনি সাফল্যের সঙ্গে দেশী হাতিয়ারে সজ্জিত এক সামরিক বাহিনী গড়ে তোলেন ।”
বিপ্লবী মজনু শাহ সম্বন্ধে যামিনী মোহন ঘোষ এবং William Hunter এর লেখা থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায় । স্বাধীনতা আন্দোলনে মজনু শাহ শহীদ হবার পরেও তাঁর দলের অন্যান্য যে নেতারা সেই সংগ্রাম বহুদিন পর্যন্ত চালিয়েছিয়েছেন তাঁদের নাম জনাব মুসা শাহ, চেরাগ আলি শাহ, মহম্মদ শাহ, পেরাগুল শাহ, মতিউল্লাহ শাহ, নিগাহ শাহ, বুদু শাহ, ইমাম শাহ প্রমুখ । এঁরা মিস্টার ম্যাকেনজির আধুনিক আগ্নেয়অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে সাময়িক পরাজিত করেছিলেন ১৭৬৯ সালে । এর নেতৃত্বে ছিলেন মজনু শাহ । ১৭৭১ সালে লেফটেন্যাট টেলর পরিচালিত ব্রিটিশ বাহিনীকে মজনু শাহের দল পরাজিত করে । লেঃ রবার্টসন ও তার সুদক্ষ বাহিনীকেও ভীষন ভাবে পরাজিত করে মজনু শাহ বাহিনী এবং রবার্টসন ঐ সময় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ছিলেন ।

ঘটনাটি হলো ১৭৭৬ সালের ১৪ নভেম্বরের । দশ বছর পরে ১৭৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট ব্রোম্যানের- এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে মজনু শাহ বাহিনীর প্রচুর লড়াই হয় । উভয় পক্ষই আহত ও নিহত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । অনেকের মতে ব্রিটিশরা পলিসি প্রয়োগ করে কিছু সন্ন্যাসীকে বিপ্লবী ফকির দলে ঢুকিয়ে দেয় । সেই হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলমান ফকিরদের মধ্যে বিভাদের বিবাদ শুরু হয়ে যায় । ব্রিটিশরা নিয়োগ করা সন্ন্যাসীর মাধ্যমে ফকির বাহিনীর গোপণ ঘাঁটি ও গোপণ বিষয়ের খবর পেয়ে যায় । তারপরে মজনু বাহিনীকে পরাজিত ও ধব্বংস করে দেয় ।

ভারতে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরাপেক্ষ রাষ্ট্র হওয়া স্বত্য়েও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পীড়িত দেশে পরিনত হয়েছে । দেশভাগ ছিল ভারত বাসীর কাছে যন্ত্রনাদায়ক । ব্রিটিশ সরকারের মদতে নোংরা রাজনীতির ও কিছু ক্ষমতা লোভী স্বার্থপর নেতার জন্য ভারত বাসীকে অনেক মুল্য দিতে হয়েছে ।লক্ষ্ লক্ষ সাধারণ নিরীহ মানুষের প্রাণ গেছে । লক্ষ্ লক্ষ মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে । বর্তমানেও ধারাবাহিকভাবে সেটি বজায় আছে।

ভারতে মুসলিমরা বর্তমানে একটি বড় সংখ্যা লঘু সম্প্রদায় । আনুমানিক প্রায় ২৫ % মুসলিম বাস করে এবং সংখ্যার হলো প্রায় ২৫ কোটি ।

আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ৬৮ বছর আগে ১৯৪৭ সালে । এই ৬৮ বছর সময় কালে বেশীর ভাগ সময় কংগ্রেস দেশ শাসন করেছে ।কিছু দিন কংগ্রেস এর অধীন ইউ পি এ এবং বিজেপির অধীন এন ডি এ। বর্তমানে কেন্দ্রে চলছে বিজেপি সরকার ।

মুসলিমরা চরম অবহেলিত ,অত্যাচারিত ও বৈষ্যমের শিকার । সরকার মুসলিম দের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ।হাজার হাজার মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা হয়েছে , হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মুসলিমদের দাঙ্গায় প্রাণ গেছে । বর্তমানেও ঘটছে। লক্ষ লক্ষ মুসলিমরা নাগরিকত্ব হারিয়েছে ৷

বর্তমানে মোদী বিজেপি সরকারের কারণে মুসলিমদের কষ্ট আরো বেড়েছে ।মুসলিম বিরোধী প্রচার তীব্র আকার ধারণ করেছে । মুসলিমদের প্রতি অত্যাচার ,ঘৃনা ,মির্থ্যা প্রচার , বৈষম্য ও দাঙ্গার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে । মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপির মির্থ্যা প্রচার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং উস্কানিতে মুসলিমদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এক বিপর্যয় আকার ধারণ করেছে ।মোদী বিজেপি সরকারের মদতে চলছে মুসলিম বিরোধী অভিযান । বিজেপির সহযোগী আর এস এস ,ভি এইচ পি , বজরং ,শিবসেনা রা নতুন উদ্দমে নেমে পড়েছে মুসলিম বিরোধী প্রচারে এবং দাঙ্গায় উস্কানি দিয়ে চলছে বিরামহীনভাবে । হুমকি , গালাগালি , কুৎসা ,মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন কোনটাই বাদ যাচ্ছে না ।

অনেক নিরীহ মুসলিমদের ,সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে জেল ভর্তি করা হচ্ছে । NRC, NPR ও CAA নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল করলো এই বিজেপি সরকার। সম্প্রতি আসামে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিল ৪০ লক্ষ মানুষের এবং পুলিশ মুসলিমদের বেছে বেছে গ্রেফতার করছে । এবং দিল্লিতে দাঙ্গা করে মসজিদ ও মুসলিম দের বাড়ি,ঘর দোকান দেখে পুড়িয়ে দিয়েছে, এবং ৭০ এর অধিক মুসলমানদের শহীদ করছে এই বিজেপি দাঙ্গাবাজ সরকার ও আর এস এস বাহিনী।তার পর বাবড়ি মসজিদ কে হস্তক্ষেপ করে সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ও মুসলিমরা ন্যায় বিচার পেল না কারণ তাদের অধীনে আইন ব্যবস্থা। জানিনা আর কত দাঙ্গা করবে ? যেভাবে বিজেপি বিভিন্ন পদ্ধতিতে অত্যাচার করছে তাতে আগামীদিনে আরো বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে ভারতবাসীর জন্য। তাই সকলের কাছে আবেদন রইল সাম্প্রদায়িক মুক্ত ভারত গড়ে তোলার জন্য ৷

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর