
যাদবপুর কাণ্ড: আদালতের বিতর্ক ও মন্ত্রীর গাড়ি চাপার অভিযোগে উত্তপ্ত রাজনীতি
গত ১ মার্চ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ছাত্রকে গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যান। এরই ধারাবাহিকতায় কলকাতা হাইকোর্টে মামলার শুনানিতে বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ ও মন্ত্রীর পক্ষের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তর্কে মুখর হয়ে ওঠে আদালত। এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মন্ত্রীর গাড়ি চাপা পড়ায় এক ছাত্রের আহত হওয়ার ঘটনায় সমালোচনার মুখেও পড়েছেন ব্রাত্য বসু। তাঁর পক্ষে লড়াই করা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
শুক্রবারের শুনানিতে ব্রাত্য বসুর নিরাপত্তা নিয়ে একপ্রকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বিচারপতি ঘোষ বলেন, ‘আপনি যাই বলুন, পুলিশের দিক থেকে যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল। আগের দিন এজি-কেও আমি বলেছি। এটা পুলিশের ব্যর্থতা।” পালটা কল্যাণ বলেন, “পুলিশের ব্যর্থতা নয়, এটা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ত্রুটি। উনি (ব্রাত্য বসু) দলের মিটিংয়ে ঢুকেছিলেন। তখন পিএসও-দের বাইরে রাখা হয়। তাই করা হয়েছিল।”

কল্যাণ বলেন, “হাইকোর্টে লিগাল সেল কোনও মিটিং ডাকলে, সেখানে আমি গেলে যদি এমন হয়, তাহলে সেই দায় কার? এখানে পুলিশ কী করবে!” বিচারপতি বলেন, ” যদি ভিড় পুলিশকে ওভারপাওয়ার করে মন্ত্রীর কাছে পৌঁছত তাহলে আমি নাহয় বুঝতাম। এখানে তো সেটা হয় নি। এখানে বৈঠকে বিক্ষোভ হয়নি। বৈঠক শেষে বেরিয়ে আসার পর যা হওয়ার হয়েছে।”
মন্ত্রী হিসেবে যে প্রোটোকল থাকে তার কথা কল্যাণকে মনে করিয়ে দেন বিচারপতি। উল্টো কল্যাণ বলেন, “এটা প্রাকটিক্যাল নয়। একজন বিচারপতির ক্ষেত্রে এই ভাবনা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মতো লোকেদের (রাজনীতিকদের) ক্ষেত্রে সবসময় প্রোটোকল মানা সম্ভব নয়।” বিচারপতি বলেন, “উনি ক্যাবিনেট পোস্টের মন্ত্রী। অবশ্যই প্রোটোকল মানা উচিত।”
এরপর কল্যাণকে সাফ সতর্ক করেন বিচারপতি। বলেন, “যাই হোক। আপনি যেভাবে কোর্টের সঙ্গে কথা বলেন… তাতে এমনভাবে প্রচার হয়, যাতে অন্তত এই কোর্ট নিজেকে অসম্মানিত মনে করছে।” এখানেও থেমে যায়নি কল্যাণ। বলেন, “একপেশে দেখানো হলে কিছু করার নেই। অনেক ট্রোলিংও হয়। এর জন্য আমি দুঃখিত। আমি আর এই কোর্টে মামলা করব না।”
জাস্টিস ঘোষ বলেন, “আমার মতে কোর্টকে ম্যালাইন (ভাবমূর্তি নষ্ট) করার চেষ্টা হয়েছে। গঠনমূলক সমালোচনা এক জিনিস, আর ম্যালাইন করা আর একেবারে ভিন্ন জিনিস।” এই সময় কল্যাণ বলেন, “কোনোভাবে আমি যদি কোর্টকে অসম্মান করে থাকি, তাহলে আমি দুঃখিত। আমি আর এই কোর্টে শুনানির জন্য আসব না।”
বিচারপতি তখন বলেন, আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে এই মামলায় শুনানিতে সওয়াল করতে পারেন। যদিও হাত জোড় করে কল্যাণ বলেন, “না। মাফ করুন। কোনও মামলাতেই আমি আর এখানে শুনানি করতে আসব না।” সবমিলিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী থাকল হাইকোর্ট।
এই দ্বৈরথ শুধু আদালতের গণ্ডিতেই সীমিত নেই। বিরোধী দলগুলি যাদবপুর কাণ্ডকে “শাসকদলের স্বেচ্ছাচারিতা” হিসাবে ফের তুলে ধরছে। অন্যদিকে, ব্রাত্য বসুর গাড়ি চাপার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা সাজানো নাটক কখনও আবার বলা হয়েছে এটি দুর্ঘটনামাত্র। ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো নয়।
এখন মূল প্রশ্ন হল আদালত-পুলিশ-বিশ্ববিদ্যালয়—কে নেবে দায়?
এই ঘটনা প্রশ্ন তুলেছে সরকারি কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতার। পাশাপাশি, রাজনৈতিক নেতাদের আইনি লড়াইয়ে জনবিচারের ভারসাম্য নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদালত ছাড়ার সিদ্ধান্ত এই বিতর্কে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
যাদবপুর কাণ্ড ও তার পরিণতি শুধু একটি আইনি মামলা নয়, বরং রাজনীতি, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কের জটিলতার প্রতিচ্ছবি। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষায় এই ঘটনা হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।