~ঝুমুর রায়
মুয়াম্মার আবু মিনিয়ার আল-গাদ্দাফিকে লিবিয়ার তাত্ত্বিক রাজনৈতিক নেতা হিসাবে এখনও মান্যতা দেন সে দেশের সাধারণ মানুষ। এমনকি সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের জনগণও একটা সময় তাঁকে নিজেদের নেতা হিসাবে মেনে চলতেন। গাদ্দাফির কূটনৈতিক দূরদর্শিতাকে ভয় পেত পশ্চিমারা। সেই ভয় দিনের পর দিন তাদের রাতের ঘুমকে হারাম করে দিয়েছিল। তাই সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে, ছলনার আশ্রয় নিয়ে অতি জনপ্রিয় এই বিপ্লবী নেতাকে হত্যা করে আমেরিকা ও তার সহযোগী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। যেমনটা তারা করেছিল ‘সবুজ ডায়েরি’ -খ্যাত বিশ্ববিখ্যাত বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার সঙ্গে।
কোনও রকম রক্তপাত ছাড়াই রাজা ইদ্রিস আল-সেনুসিকে লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে সে দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। তখন থেকেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বীজ রোপণ করা হয়ে গিয়েছিল লিবিয়ার মাটিতে। গাদ্দাফি জন্মেছিলেন হতদরিদ্র একটি পরিবারে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে। এমনও সময় গেছে যে, কোনও কোনও দিন তাঁকে শুধুমাত্র উটের দুধ পান করেই সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে হয়েছে। সেইসময় কৃষিকাজ করার জন্য দেশে জলের সঙ্কট ছিল অত্যন্ত। সেই দিনগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন গাদ্দাফি। আগেই বলেছি কোনও প্রকার রক্তপাত ছাড়াই দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করেছিলেন গাদ্দাফি। যদিও এক্ষেত্রে তিনি সহযোগিতা পেয়েছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের কাছ থেকে। লিবিয়ার সাবহা অঞ্চলের একটি স্কুলে পড়তে পড়তেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করতেন গাদ্দাফি। সেই কারণে সাবহা থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। অবশ্য ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসেই পাকাপাকিভাবে লিবিয়ার মসনদে বসেন তিনি।
গাদ্দাফি ক্ষমতা দখল করার পর লিবিয়ার দেশি-বিদেশি সকল তেলের কোম্পানিগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। সরকারের অধীনস্থ লিবিয়ার নতুন তেল কোম্পানি ‘ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি’ দেশের তেল চড়া দামে বিদেশে বিক্রি করতে শুরু করে। এরফলে ফাঁপড়ে পড়ল বিশ্বব্যাংক, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, রাতের ঘুম উবে গেল। এমত অবস্থায় বিশ্বব্যাংক গাদ্দাফিকে চিঠি লিখে অনুরোধ করল, “আমরা আপনাকে সবরকমভাবে সাহায্য করব। কিন্তু তার আগে আপনি তেল কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণ বাতিল করুন। শুধু এতটুকু করলে আমরা সকল প্রকার সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি।” কিন্তু দূরদর্শী গাদ্দাফি তাদের ছলনা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে বিশ্বব্যাংকের কথায় কর্ণপাত করেননি তিনি। তাই তেল কোম্পানীগুলোর জাতীয়করণও বাতিল করেননি। বরং তেল বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করে লিবিয়াকে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে তৈরী করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এবার একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক গাদ্দাফি দেশের সমৃদ্ধির জন্য কী কী করেছিলেন সেদিকে…
১.সকল শিশুর জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। সকলের জন্য এই শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক।
২. বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন।
৩.শহরে অত্যাধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করেন।
৪.গ্রামে প্রতি তিন কিলোমিটার অন্তর চালু করেন সরকারি ক্লিনিক।
৫.নারীদের জন্য কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন এবং নিরাপত্তা প্রদান করেন।
৬.আইন করে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করেন। সেই আইন কেউ ভাঙলে শাস্তির বিধান হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেবার ব্যবস্থা করেন।
৭.ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে সরকারি আবাসিক প্রকল্প চালু করেন।
৮.মানবসৃষ্ট নদী তৈরি করেন যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট নদী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রকৃতি লিবিয়াকে তেল দিয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু জল দেয়নি। সেই কারণেই গাদ্দাফি এই মানবসৃষ্ট বিশাল নদী তৈরি করেন। তিনি চেয়েছিলেন পুঁজিবাদকে ধ্বংস করতে। সে পথে তিনি সফলও হয়েছিলেন। এদিকে মানবসৃষ্ট নদী প্রকল্পের কাজের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থ চেয়েছিলেন গাদ্দাফি, কিন্তু বিশ্বব্যাংক টাকা দিতে অস্বীকার করে। তবুও দমে যাননি তিনি। বরং সম্পূর্ণ প্রকল্পের অর্থ তিনি লিবিয়ার রাজকোষ থেকে বরাদ্দ করেন। প্রকল্পটির কাজ দু-দফায় শেষ হয়। প্রথম দফার কাজ শেষ হয় ১৯৮৯ সালে এবং দ্বিতীয় দফার কাজ শেষ হয় ২০০৭ সাল নাগাদ। মানবসৃষ্ট নদীতে ১৬০০ মাইল পাইপলাইন যোগ করা হয়। চারশো বড় বড় কুঁয়ো খনন করে এগুলোর মাধ্যমে লিবিয়ায় কৃষিকাজে জলের সঙ্কট নিরসন করা হয়। এই জলের বিনিময়ে লিবিয়ায় ফল ও সবজি উৎপাদন হাজার হাজার টন বেড়ে যায়। লিবিয়ার এই সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং আমেরিকা মেনে নিতে পারেনি। তারা ভালো চোখে দেখেনি গাদ্দাফির এই উত্তরণকে। তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল লিবিয়ার উন্নয়ন। তাই তারা সবসময় সুযোগ খুঁজছিল এই সমাজতান্ত্রিক উন্নয়ন ব্যবস্থায় আগুন লাগাতে। কারণ এরা পুঁজিতন্ত্রকে পছন্দ করে, সমাজতন্ত্রকে নয়। এরা ঘৃণা করে অন্য দেশের জনগণের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর অধিকারকে, তাদের তেল কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই লিবিয়ার তেলের খনি লুট করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার জন্য তারা বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। অবশেষে তাদের সেই অপচেষ্টা সফল হয়। ২০১১ সালে আমেরিকা লিবিয়া আক্রমণ করে গাদ্দাফিকে খুন করে। গাদ্দাফিকে হত্যা করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলিও সংঘবদ্ধ হয়। এমনকি এ বিষয়ে তারা মুসলিম বিশ্বের কিছু বেইমান রাষ্ট্রনেতাকেও পাশে পেয়ে যায়। লিবিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর চলে দমন-পীড়ন। তাদের ওপর অনবরত গোলাবারুদ নিক্ষেপ করে আমেরিকা আর তার মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলো। অবশেষে বীর বিপ্লবীনেতা গাদ্দাফি নিহত হন পুঁজিবাদীদের হাতে। গাদ্দাফির পতনের সাথে সাথে পুনরায় পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠা হয় লিবিয়ায়।
২০১১ থেকে ২০২২। গাদ্দাফি মারা যাওয়ার পর এগারো বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু সমাজতন্ত্র আর ফিরে এলো না লিবিয়ায়। সেখানকার বর্তমান শাসকরা হলেন আমেরিকার হাতের পুতুল। তাদের কথাতেই তাঁরা ওঠেন বসেন। এর ফলও ফলেছে হাতেনাতে। লিবিয়া বর্তমানে বিশ্বের গরিব দেশের তালিকায় প্রথম দিকে জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তেল কোম্পানীগুলিকে আবার তুলে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাতে (পড়ুন আমেরিকার হাতে)। সমৃদ্ধ লিবিয়ার তেলের খনিগুলো দখল করেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। দেশের সমস্ত তেল তারাই লুট করে নিয়ে গিয়েছে। এখনও অবাধে চলছে সেই লুটপাট। এর বিনিময়ে লিবিয়াকে তারা উপহার দিয়েছে অপুষ্টি-দারিদ্র্য। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী লিবিয়ার বর্তমান জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তির মূল কারণ হল পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা। এই পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার জন্মদাতা হল আমেরিকা আর তার দোসর ইউরোপীয় দেশগুলি। এরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে লুট করার জন্য প্রয়োজনে সবকিছু করতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ইরাক, লিবিয়া, প্যালেস্টাইন সহ আফ্রিকা-এশিয়ার অসংখ্য দেশ। তাই এদের বিশ্বাস করা যতটা ক্ষতিকর, তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হল এদের জায়গা দেওয়া। তাই সমাজতান্ত্রিক নেতা কর্নেল গাদ্দাফির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁর দেখানো পথেই শুরু হোক পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াই।