প্রকাশিত হয়েছে কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের নতুন এবং “শেষতম” গ্রন্থ “কালো রং, লাল ছবি”। বই জুড়ে রয়েছে সমাজব্যবস্থা,বিশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে এক তুলি কলমের প্রতিবাদ। বিপ্লবীরা প্রতিবাদ জানাতে বাঁধেন বোমা, আর শিল্পীরা চালান তুলি,ঘোরান কলম।প্রতিবাদী দুজনেই,তাঁদর নিজের মত করে। কি লিখলেন কৃষ্ণজিৎ বাবু,রইল তাঁর কলমেই –
“শিল্পিত গর্জন : সৃজনশীলতার প্রথম উদ্দেশ্য অবশ্যই আনন্দলাভ। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজে যেমন আনন্দ পান, তেমনিই তা বিলিয়ে দেন অন্যদেরও। কিন্তু সৃষ্টি মানেই যে সবসময় আনন্দ আর হৈহৈ তা-তো নয়। জগতের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে শিল্পকর্মের গড়ে ওঠা। শিল্পে দক্ষতা নিশ্চয়ই একটা বড়ো ব্যাপার। সেই কারণে অবশ্য অনেকেই মনে করেন শুধুমাত্র দক্ষতার প্রকাশই বুঝি শিল্পকলা। দক্ষতার কেরামতিতে মুগ্ধ মানুষ হাততালি দেয়। কিন্তু দক্ষতাকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানিয়েও একথা আমি বিশ্বাস করি যে– শিল্পীর ভূমিকা দক্ষতার ভেল্কিবাজিতে আটকে গেলে চলে না। সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব আছে। তাই সমাজ ও জাতির দুর্দিনে স্রষ্টাকে অন্যরকমভাবে সক্রিয় হতেই হবে। চাঁদ তারা ফুল পাখির গান, পরিপাটি গ্রাম-শহরের নিসর্গ কিংবা স্বপ্নিল প্রেমের মাধুর্যের কথা সুন্দর ভঙ্গিতে বলে গেলেই একজন শিল্পী সার্থক মানুষ হতে পারেন না। তাক্ লাগানোর পাশাপাশি কম জরুরি নয় বিপর্যস্ত সময়কালে উপযুক্ত কথাগুলো শিল্পের ভাষাতেই মানুষকে জানানো। আর সেকাজে হাতের দক্ষতার সঙ্গে মানসিক দক্ষতাও চাই তুমুলভাবে। একমাত্র সেই দক্ষতাই পারে চতুর্দিকের অসঙ্গতি, অবমাননাকে শনাক্ত করতে। অকুতোভয় শৈল্পিক দৃপ্ততা অবশ্যই খুব কম শিল্পীর সৃজনে ফুটে ওঠে। আমার সৌভাগ্য যে প্রথম যৌবন থেকেই আমি সেইরকম শিল্পীদের কাজকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আর সেই ভালোবাসা আজও অব্যাহত। জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ হোর, কামরুল হাসান, শাহাবুদ্দিনের ছবি যেন আমার রুচির স্থায়ী ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। সেই ঠিকানায় ঘর বেঁধে আজ পর্যন্ত কত ছবি দেখলাম, আঁকলাম। যুগন্ধর শিল্পীরা প্রকৃতি ও প্রাণের সৌন্দর্য নিয়ে কম ছবি আঁকেননি। কিন্তু তাই বলে তাঁরা কোনোদিনই সৌন্দর্যসর্বস্ব শিল্পী ছিলেন না। মানবকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কহীন ‘সুন্দর’-কে তাঁরা স্বীকার করেননি। তাই রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এইসব শিল্পীরা বারেবারে ছবি এঁকেছেন। তাঁদের সৃষ্টি কখনও কখনও সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সমাজের বিরুদ্ধে, শাসকের বিরুদ্ধে, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও। চিত্তপ্রসাদ এঁকেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের ছবি, জয়নুল আবেদিন এঁকেছেন বুভুক্ষু মানুষের কষ্টের মুহূর্ত, সোমনাথ হোর এঁকেছেন আর্ত মানুষদের যন্ত্রণার ছবি, নারী নির্যাতনের ভাস্কর্য, কামরুল হাসান স্বৈরাচারী শাসকের নরখাদক চেহারা এঁকে তাকে হত্যার করার ডাক পর্যন্ত দিয়েছেন। দেবব্রত মুখোপাধ্যায় সরাসরি রণাঙ্গনে গিয়ে এঁকেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের ছবি, সেইসব ছবি আঁকতে আঁকতেই হাতে ধরে বিপ্লবীদের শিখিয়েছেন বোমা ছোঁড়ার কৌশল। তাঁর কাঁধের ঝোলায় একই সঙ্গে থাকতো হাতবোমা ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম। শাহাবুদ্দিন সাময়িকভাবে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে রাইফেল হাতে বিপ্লবীদের দলে যোগ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় পরবর্তী জীবনে তিনি যোদ্ধার গতি, বিজয়ীর আনন্দের ছবিও এঁকে গেছেন অজস্রধারায়। এইসব বীর দেশপ্রেমিক মানবদরদী শিল্পীদের ভক্ত হয়ে আমি কি করে আঁকতে পারি কেবলই হংসমিথুন, পুষ্পের পেলবতা কিংবা নারীর কটাক্ষ। বিশেষ করে এই দুঃসময়ে। যখন অনবরত নারী, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু নিপীড়ন-হত্যা হয়ে চলেছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর মদতে। যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শিক্ষিত মানুষেরাও শারীরিক-দূরত্ব আর সামাজিক দূরত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে পারছেন না। যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম পাহাড়চূড়ায় এন্ডমন্ড হিলারির মতো পতাকা নাড়ছে আর বিচারপতিরা বিক্রি হচ্ছেন রাতের অন্ধকারে। যখন দুর্বৃত্তরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, আর নেতারা পোশাক পাল্টানোর মতো করে দল বদলাচ্ছেন, ঠিক তখনই নির্বাচন কমিশন বলছেন এদেরকে ভোট না দিলে নাকি আমরা মোক্ষলাভ করবো না, ঠিক তখনই তো কাগজ আর ক্যানভাসের ওপর তুলির দাগের চিৎকার করে ওঠার সময়।
<span;>নয়ত আমারও তো ইচ্ছে করে দেশ রাগের সজল সৌন্দর্য আঁকতে, সাধ হয় অগাধ নদীর জলে ছিপছিপে নৌকোর আলপনা ফুটিয়ে তুলি চিত্রপটে। কেন আঁকি নিরন্ন কর্মহীনদের মুখ, ক্ষুধার্তের গোগ্রাস, আহত লাঙলের শরশয্যা! বাঘা যতীন, বিনয়-বাদল-দিনেশ কিংবা সূর্য সেনের মতো দৃপ্ততা থাকলে হয়তো অন্যকিছু করতাম। আপাতত ছবি এঁকে ফেটে পড়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই আমার।
এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েই আমার শেষতম বই
*কালো রং লাল ছবি* -এর প্রকাশ। যাবতীয় ক্লীবতার বিরুদ্ধে শিল্পিত গর্জন।”