হাজার কবিতা – বেকার সবই তা। কিন্তু তাদের কথা কেউ বলে না

~সৌমিত্র বসু

  1. উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ থেকে 41জন শ্রমিককে উদ্ধার করার নায়ক, দিনে কুল্লে 300-700 টাকা রোজগার করা “rat miner”রা তাঁদের অসাধারণ সাফল্যের পরেও পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকার করেছেন, কারণ, তাঁদের কথায়, একাজ তাঁরা করেছেন “দেশের জন্য”, সহনাগরিকদের সাহায্য করা তাঁদের সাধারণ কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
    “দেশের জন্য” কুমীরদের চোখের জল ফেলতে দেখে দেখে যখন “দেশ” শব্দটাকেই হাস্যকর মনে হয়, তখন এঁদের কথা পড়ে চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। মনে হল, এইজন্যই কবি একবার মানুষের দিকে তাকানোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।

যদিও, কোন তুলনা হয় না, তবুও মনে পড়ল, আমার নিজের এক অভিজ্ঞতার কথা। একবার কলকাতার ফুটপাথে হঠাৎই কংক্রিটের চাঙড় ভেঙে আমি পড়ে যাই, আমার পা নীচে দিয়ে প্রবাহিত নর্দমার গর্তে ঢুকে আটকে যায়। টেনে তুলতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, পা-টা ভেঙেই যাবে বুঝি। ভালো করে কিছু ভাবার আগেই কোথা থেকে ছেনি হাতুড়ি নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন কয়েকজন মানুষ। ভীড় সরিয়ে অতি সাবধানে অপরিসীম ধৈর্য্য ও মমতা নিয়ে চাঙড় ভাঙার কাজ শুরু করে দিলেন দু-তিনজন। বেশ কিছুটা মুক্ত হওয়ার পর আবার আমার হাঁটু বেকায়দায় আটকে গেল চাঙড়ের লোহার খাঁচায়। সেই কঠিন লোহার রড বাঁকানোর যন্ত্রও জোগাড় হয়ে গেল আশেপাশেই। আধঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ অক্ষত আমি উদ্ধার পেলাম। ভ্যাবাচাকা ভাব কাটিয়ে উঠে এক-দু মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকর্তাদের ধন্যবাদ দেবার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, সব ভোঁ ভাঁ। যে যার কাজে চলে গেছেন সময় নষ্ট না করে, কোন কিছুর প্রত্যাশা না করে, এতটুকু বড়াই না করে।

শ্রমজীবী মানুষদের এই সহমর্মিতা, পুরস্কারের প্রতি উদাসীন এই কর্তব্যনিষ্ঠা, এই সততার প্রমাণ জীবনে বারেবারে পাই। তবু, এদিকে আমাদের সহজে নজর পড়ে না। আমাদের মত চরম সুবিধাবাদী, ভীরু অথচ আত্মম্ভরী, বচনবাগীশ এবং ধান্দাবাজ, স্বার্থপর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত লোকজন, যারা উপরওয়ালা এবং পয়সাওয়ালা ছাড়া কাউকেই সম্মান করতে শিখি না, তারা প্রতি পদে খেটে খাওয়া মানুষদের ছোট করে, তাদের উপর লাঠি ঘুরিয়ে অভ্যস্ত। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি – যাঁদের শ্রম ছাড়া আমার প্রতিটি দিন বাঁচা অসম্ভব, যাঁরা মানবসমাজের এই বিরাট চাকাটা গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের সামনে হাঁটু মুড়ে বসি, বলি তোমার চরিত্র আমাকে দাও, একটু বিনয় শেখাও আমাকে, সত্যিকার কাজ করতে শেখাও।

  1. 41 জন শ্রমিক সুড়ঙ্গ থেকে একেবারে সুস্থ হেঁটে বেরিয়েছেন। শুধু কারো কারো রক্তচাপ বেড়েছে একটু। এও এক আশ্চর্য! আমি নিশ্চিত, ঐ গর্তের অন্ধকারে 17 দিন বন্দী থাকলে যেকোন বাবু ঘরের লোক আতঙ্কেই মারা যেত। কিন্তু যারা সুড়ঙ্গে কাজ করে অভ্যস্ত, এবং, বাধ্য, যেকোন সময় “ইঁদুরের মত মারা পড়তে পারি” জেনেও তাদের মাথা ঠাণ্ডা থাকে। বাইরে থেকে পাঠানো অক্সিজেনের পাইপ তারা নিজেরা পেতে নেয়, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা কোনখানে তা জানানো হলে সঠিক দিকনির্ণয় করে সুশৃঙ্খলভাবে সেখানে সরে যায় সকলে, কী অশেষ ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করে পুনরুজ্জীবনের। এই প্রজ্ঞাবান অধ্যবসায়কে নমস্কার, এই অদম্য প্রাণশক্তিকে প্রণাম।

মনে হয়, এই নাছোড়বান্দা মনোবল, এই দৃঢ়তা ঐ ব্যক্তি শ্রমিকদের বিশেষ গুণ নয়, শ্রমজীবীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাই বলে। যে কঠিন জীবন সবসময়ই অনিশ্চয়তার দাঁড়ের উপর নিজেকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ চালায়, বিপদ তাকে সহজে বিচলিত করতে পারে না। লকডাউনের সময় হাজার হাজার শ্রমিকের সপরিবারে হাজার-দেড় হাজার মাইল হেঁটে ফেরার দৃশ্যও এই সত্যকে দেখিয়েছিল।
তাই শ্রমিকদের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও ভরসা হয়, পৃথিবীর ক্রমমুক্তির আশা জাগে। আকাশের ভয়ঙ্করকে শান্ত গলায় জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, আমরা ভয় পাই নি।

  1. যেসময় মেশিন “আমি মানুষের হব প্রতিদ্বন্দ্বী” বলে শ্রমনিবিড়, বুদ্ধিনিবিড় সমস্ত কাজ, মায় কবিতা, থিসিস পর্যন্ত পটাপট রচনা করে ফেলছে, জনগণ সপ্তাহে তিনদিন কাজ করে বেকারভাতা নিয়ে বাকি চারদিন সাম্যবাদসদৃশ অবসরে পরমানন্দে জীবন কাটাতে পারবে বলে স্বপ্ন ফিরি করছে পুঁজিবাদের একনম্বর প্রতিনিধি, সেসময় মার্কিন অগার মেশিনকে ইঁদুরে খনিশ্রমিকরা টেক্কা দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই শোরগোল পড়ে গেছে। অনেকেই এতে শ্রমের তথা মানুষের জয় দেখে আনন্দিত।
    কিন্তু, সত্যিই তো আর মানুষ মেশিনের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। মেশিন মানুষের শ্রম ও মননেরই উৎপাদ। কলের পুতুল যতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কীর্তিতে চমৎকৃত করুক, মানুষের সৃষ্টি পাহাড়প্রমাণ তথ্য না পেলে, মানুষ প্রোগ্রাম না করে দিলে শেষ পর্যন্ত সে জড়ভরত। কিন্তু হাতুড়ি থেকে স্টীমরীল পেরিয়ে আজকের কম্পিউটারাইজড মেশিন আমাদের লাফ দিয়ে, লাফ দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে – একথা অস্বীকার করার কোন জায়গা আছে কি? তাই মেশিনকে কাজে না লাগানোর চিন্তা আসলে পেছনদিকে ফেরা। কেনই বা সুড়ঙ্গে ঢুকে কাজ করবে মানুষ নিজে? কেনই বা মেশিন অগণিত মানুষকে মুক্তি দেবে না পাতি, পুনরাবৃত্তিমূলক, চিন্তাহীন পিঠভাঙা খাটনির কাজ থেকে? বরং আমরা দাবী করব, যাতে মেশিনকে মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন অনুসারে আরো উন্নত করা যায়, যাতে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধি যন্ত্রপাতি আটকে গেলে সেগুলো সারাই করতে পারে, সমস্যার নতুন সমাধান দিতে পারে। মেশিন নিশ্চয়ই একদিন পৃথিবীর সবার জন্য সমানভাবে মানুষের যোগ্য অবকাশ তৈরী করে দেবে, এটাই আশা রাখি।
    মেশিন আমাদের বন্ধু না শত্রু হবে, সেই আসল ব্যাপারটা, মনে হয়, কলকাঠি কারা নাড়ছে, তার উপরেই নির্ভর করে। নজরটা সেদিকে ফেরানো দরকার।

Latest articles

Related articles