~ইফতে খায়রুল
ভারতীয় ইতিহাসে যে কয়টি বর্বর, নিষ্ঠুর ও মানবাতা বিরোধী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সতীদাহ প্রথা। হিন্দু ধার্মিকেরা অতি নিষ্ঠার সাথে এই প্রথা উৎযাপন করতো। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, স্বামীর মৃত দেহের সাথে স্ত্রীকে জোরপূর্বক জীবন্ত দাহ করা হতো। সতীদাহ প্রথা বন্ধের প্রথম সরকারি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন মুসলিম শাসকেরা। মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বপ্রথম এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হুমায়ুন স্থানীয় হিন্দুদের প্রতিবাদের মুখে পড়েছিলেন। অনেক সময় মুঘল প্রশাসন থেকে বিধাব মহিলাদের বেতন ভাতা, উপহার, পুনর্বাসন ইত্যাদি সাহায্য দেওয়া হতো সতীদাহ না করার জন্য। সম্রাট শাহজাহানের সময় নিয়ম ছিল কোন অবস্থাতেই যেসব মহিলাদের সন্তান আছে তাদের দাহ হতে দেওয়া হবে না। সব থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। ১৬৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি রুল জারি করেন, কোন পরিস্থিতিতে মুঘল কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দেশের কোথাও সতীদাহ ঘটতে সরকারি অনুমতি দেওয়া হবে না। অথচ পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয় রাজা রামমোহন রায় এবং বৃটিশ গভর্নর উইলিয়াম বেন্টিংক এই প্রথা বন্ধের অন্যতম পুরোধা। হিন্দু সমাজের এই চরম বর্বর ও অমানবিক প্রথা উচ্ছেদে মুসলিম শাসকদের অবদানকে পরিকল্পিত ভাবেই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। ভুলে গেলে চলবে না, ইতিহাস কথা কয়। ইতিহাসের শ্বাসরোধ করা যায় না। রাজা রামমোহন রায় দু’টো কারণে সতীদাহ প্রথা বন্ধের পক্ষে ছিলেন। প্রথমতঃ তার ভাইয়ের স্ত্রীকে জোরপূর্বক সতী বানানোর ঘটনা দেখে এই প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। দ্বিতীয়তঃ ইসলামের প্রভাব। রাজা রামমোহন রায় ইসলাম সম্পর্কে গভীরভাবে পড়াশোনা করেন, কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন করেন এবং সুফীবাদ দ্বারা প্রভাবিত হন। এমতাবস্থায় তিনি মূর্তিপূজা ছেড়ে দেন এবং একেশ্বরবাদী হয়ে যান। ফলে পিতার সাথে মতবিরোধের কারণে তাকে গৃহত্যাগ করতে হয়। তাই একেশ্বরবাদী রাজা রামমোহন রায়ের মনন সৃষ্টিতে ইসলামের অবদান অস্বীকার করা যায় না। এ জন্য তার দ্বারা যদি হিন্দু ধর্মের কোন উপকার হয়ে থাকে, তাহলে সেই উপকারের পিছনে ইসলামের নাম রাখতেই হবে।

বর্তমান সময়ে ইসলাম বিদ্বেষী কোন কোন ব্যক্তি সহমরণ বা সতীদাহকে কেবলমাত্র মুসলিমদের হাত থেকে সম্মান বাঁচানোর জন্য হিন্দু নারীদের পবিত্র আত্মহুতি হিসেবে দেখাতে চান। তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রশ্ন, পান্ডুর স্ত্রী মাদ্রী, বাসুদেবের স্ত্রী দেবকী কিংবা কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্ষ্মিণীও কি মুসলিমদের হাত থেকে বাঁচতে নিজ নিজ স্বামীর সাথে চিতায় পুরে মরেছিলেন? রামের মা কৌশল্যা কোন্ মুসলিমের হাত থেকে সম্মান বাঁচাতে দশরথের সাথে সহমরণে যেতে মনস্থির করেছিলেন? তখন কি ভারতে মুসলিমদের অস্তিত্ব ছিল? মহাভারতের ভাষ্যমতে রাজা পাণ্ডু মারা গেলে তার স্ত্রী মাদ্রী স্বামী সহগমণ কামনায় প্রাণ ত্যাগ করেন (মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায়- ২০, পৃঃ ৫১, রাজ শেখর বসু অনুদিত), বাসুদেব মারা গেলে তার স্ত্রী দেবকী, ভদ্রা, মদিরা ও রোহিণী স্বামীর চিতায় আরোহণ করে তার সহগামিনী হলেন (মহাভারত, মৌষলপর্ব, অধ্যায়-৪, পৃঃ ৬৭৫), রুক্ষ্মিণী প্রমুখা কৃষ্ণের আটজন প্রধানা স্ত্রী ছিলেন, তারাও তার সাথে চিতার আগুনে প্রবেশ করে সহমরণ বরণ করেছিলেন (বিষ্ণুপুরাণ, পঞ্চমাংশ, অধ্যায়- ৩৮, শ্লোক- ২), রাজা দশরথ মারা গেলে রামের মা স্বামীর দেহ আলিঙ্গন করে আগুনে প্রবেশ করার আকাঙ্খা ব্যাক্ত করেছিলেন (বাল্মীকি রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড, সর্গঃ ৬৫-৬৮, পৃঃ ১০০, রাজ শেখর বসু অনুদিত )।
এটা ঠিক যে বেদে সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার নিয়ম বর্ণিত হয় নি, কিন্তু বেদের প্রমাণ হতে দেখা যায় এ প্রথা বেদের চেয়েও প্রাচীন। অথর্ববেদ ১৮/৩/১/১-২ এ বলা হয়েছে-
ইয়ং নারী পতিলোকং বৃণানা নি পদ্যত উপ ত্বা মর্ত্য প্রেতম্ । ধর্মং পুরাণমনুপালয়ন্তী তস্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি। অপশ্যং যুবতিং নীয়মানাং জীবাং মৃতেভ্যঃ পরিণীয়মানম্ ॥
অনুবাদঃ “এ পুরোবর্তিনী স্ত্রী সহধর্মচারিণী বলে পতির অনুষ্ঠিত যাগাদি কর্মের ফলরূপ স্বর্গাদি লোক বরণ করতে চায়। হে মরণশীল মানুষ, এ স্ত্রী ভূলোক থেকে নির্গত তোমার কাছে অনুমরণের জন্য পুরাতন ধর্ম অনুপালনের জন্য যাচ্ছে। সে অনুমরণে গমনশীল স্ত্রীর জন্য জন্মান্তরেও এ ভূলোক পুত্রপৌত্রাদি ও ধন দাও। হে ধর্মপত্নী, এ জীবলোকের উদ্দেশে পতির কাছ থেকে উঠে এস।”
এ মন্ত্র হতে কয়েকটি বিষয় আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ঃ
১.একজন নারীর মধ্যে মৃত স্বামীর সাথে সহমরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
২. তাকে সহমরণে নিরুৎসাহিত বা নিষেধ করা হচ্ছে। ৩. সহমরণ প্রথা স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর হওয়ায় বলা হচ্ছে, নারীটি পুরাণমনু পালয়ন্তী ‘পুরাতন ধর্ম” পালনের জন্য যাচ্ছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সহমরণ প্রথা অনেক প্রাচীন, বেদের থেকেও প্রাচীন। হিন্দুরা বলে, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে কোথাও সহমরণ বা সতীদাহের নিয়ম নেই। আমরা দেখার চেষ্টা করবো তাদের এ দাবি কতটা সত্য।
প্রথমেই আমরা দেখবো ঋষি পরাশর সহমরণ সম্পর্কে কি বলেন। তিনি ছিলেন একজন বৈদিক ঋষি এবং বহু মন্ত্রের দ্রষ্টা। মহাভারতের বর্ণানুসারে মাতৃগর্ভে থেকেই তিনি বার বছর বেদ পাঠ করেছিলেন। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি কিভাবে পালন করবে তার নির্দেশনা দিয়ে রচনা করেছিলেন ৫৮২ টি শ্লোক সংবলিত ‘পরাশর সংহিতা’। তিনি লিখেছেনঃ
নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীগাৎ পতিরন্যো বিধীয়তে।।
মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী ব্রহ্মচর্য্যে ব্যবস্থিতা।
সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ।।
তিস্রঃ কোট্যোহর্দ্বকোটী চ যানি রোমাণি মানবে।
তাবৎ কাল বসেৎ স্বর্গং ভর্ত্তারং যানুগচ্ছতি।।
ব্যালগ্রাহী যথা ব্যালং বিলাদুদ্ধবতে বলাৎ।
এবদুদ্ধৃত্য ভর্ত্তারং তেনৈব সহ মোদতে৷৷
অনুবাদঃ “আর স্বামীর মরণে যিনি সহমৃতা হন, সেই স্ত্রী, মানবদেহে যে সার্দ্ধত্রিকোটী সংখ্যক রোম আছে, তাবৎপরিমিত কাল স্বর্গ ভোগ করিতে থাকেন। ব্যালগ্রাহী যেমন গর্ত্তমধ্য হইতে, সর্পকে বলপূর্ব্বক টানিয়া আনে, তেমনি সহমৃতা নারী মৃতগতিকে উদ্ধার করিয়া, তৎসহ স্বর্গসুখ ভোগ করেন।” (পরাশর সংহিতা, ৪/২৬-২৯)
ব্যাসদেবের পরিচয় ভারতবর্ষে সর্বজন বিদিত। তিনি মহামুনি পরাশরের পুত্র, বশিষ্ঠের প্রপৌত্র। একাধারে তিনি বেদ বিভাগকর্তা, মাহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণ রচয়িতা। তিনি তার সংহিতায় বলেছেনঃ
মৃতং ভর্ত্তারমাদায় ব্রাহ্মণী বহ্নিমাবিশেৎ।
জীবন্তী চেত্ত্যক্তকেশা তপসা শোধয়েদ্বপুঃ।।
সৰ্ব্বাবস্থাসু নারীণাং ন যুক্তঃ স্যাদরক্ষণম্ ।
তদেবানুক্রমাৎ কার্য্যং পিতৃভর্ত্তৃসুতাদিভিঃ।।
জাতাঃ সুরক্ষিতা যা যে পুত্রপৌপ্রপৌত্রকাঃ।
যে যজন্ত পিতৃন খজ্ঞৈমোক্ষপ্রাপ্ত মহোদয়ৈঃ।।
দাহয়েদবিলম্বেন ভাৰ্য্যাঞ্চাত্র ব্রজেত সা।।
অনবাদঃ “মৃত ভর্ত্তার সহিত অগ্নিপ্রবেশ করিবে অথবা আজীবন ব্রহ্মচর্য্য করিবে। নারীগণ কোন সময়েই অরক্ষিত থাকিবে না; অতএব ক্রমে পিত্রাদি তাহার রক্ষা করিবে। ঐরূপ ভার্য্যাকে দাহ করাইবে, ভাৰ্য্যা যাযজুক স্বামীর সালোক্য লাভ করিবে।” (ব্যাস সংহিতা, ২/৫৩-৫৬)
দক্ষসংহিতার শুরুতেই বলা হয়েছে, ব্রহ্মার মানস পুত্র প্রজাপতি দক্ষ চতুরাশ্রমের মানুষের উপকারের জন্য এই শাস্ত্র রচনা করেছেন। তিনি বলেনঃ
মৃতে ভর্ত্তরি যা নারী সমারোহেদ্ধুতাশনম্ ।
সা ভবেত্তু শুভাচারা স্বর্গলোকে মহীয়তে।।
ব্যালগ্রাহী যথা ব্যালং বলাদুদ্ধরতে বিলাৎ।
তথা সা পতিমুদ্ধৃত্য তেনৈব সহ মোদতে।।
তেষাং জাতান্যপত্যানি চাণ্ডালৈঃ সহ বাসয়েৎ।।
অনুবাদঃ “ভর্ত্তার মৃত্যু হইলে, যে স্ত্রী স্বামীর চিতারোহণ করে, সেই স্ত্রী সদাচার সম্পন্না হইবে এবং স্বর্গে দেবগণের পূজ্য হইবে। ব্যালগ্রাহী (সাপুড়িয়া) যেমত গর্ত্ত হইতে বল দ্বারা সর্পগণকে উদ্ধার করে, সেইরূপ পতিসহগামিনী স্ত্রীর পতি যদ্যপি নরকস্থ থাকে, তাহাকেও নিজপূণ্যবলে উদ্ধার করিয়া পতির সহিত (স্বর্গলোকে) সহর্যে কালযাপন করে।” (দক্ষসংহিতা, ৪/১৯-২১)
বিষ্ণু সংহিতায় আচার, ব্যবহার ও প্রায়শ্চিত্ত সমস্ত বিষয়ই আলোচিত হয়েছে। সংহিতার প্রারম্ভে বলা হয়েছে ভগবান বিষ্ণুই এই সংহিতার আইনপ্রণেতা। তিনি বলেনঃ
বাল্যযৌবনবাৰ্দ্ধকেষপি পিতৃভর্ত্তৃপুত্রাধীনতা।।
মৃতে ভর্ত্তরি ব্রহ্মচর্য্যং তদন্বারোহণং বা।।
অনুবাদঃ “সকল কৰ্ম্মেই অস্বতন্ত্রতা (যথাক্রমে) বাল্য, যৌবন ও বার্দ্ধক্যে পিতা, ভর্ত্তা ও পুত্রের বশে থাকা, ভর্ত্তার মৃত্যু হইলে, ব্রহ্মচর্য্য কিংবা ভর্ত্তার সহগমন বা অনুগমন (স্ত্রীলোকের ধর্ম্ম)।” (বিষ্ণুসংহিতা, ২৫ / ১৩-১৪ )

অত্রির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় ঋগ্বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের অন্যতম রূপে। পুরাণে অগ্নি ব্রহ্মার মানস পুত্র এবং দত্তাত্রেয়, চন্দ্র ও দুর্বাসার পিতা। অত্রিপ্রণীত সংহিতাটিকে মনু, যাজ্ঞবল্ক্যের তুলনায় অতি সংক্ষিপ্ত বলা যায়। তিনি তার সংহিতায় বলেনঃ
চিতিভ্রষ্টা তু যা নারী ঋতুস্ৰষ্টা চ ব্যাধিতঃ।
প্রাজাপত্যেন্ শুধ্যেত ব্রাহ্মণান। ভোজয়েদ্দশ।।
অনুবাদঃ “স্ত্রীলোক সহমরণ বা অনুসরণ করিতে গিয়া চিতা হইতে পতিত হইলে বা রোগ দ্বারা রজোহীন হইলে “প্রজাপত্য” ব্রত করিয়া এবং দশজন ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়া শুদ্ধ হইবে।” (অত্রিসংহিতা, শ্লোক-২০৯)
সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রমাণিত হলো, মুসলিমরা ভারতবর্ষে আগমনের পরে নয়, বরং বেদ ও সংহিতার যুগের পূর্বেও সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিলো।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)