বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু আবেগ নয়, বাঁচার লড়াই

NBTV ONLINE DESK

NBTV ONLINE DESK

IMG-20200804-WA0123

এই লেখাটা এমন একটা সময় লিখছি যখন “বাঙালি” অভিনেত্রী রিয়া চক্রবর্তী কে নিয়ে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল। বিভিন্ন হিন্দি নামধারী টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বাঙালি মেয়েদেরকে “পয়সাওলা সুপুরুষ ছেলে তুলতে জানে”, “হিংস্র”, “ছেলেদেরকে চাকর করে রাখে”, “কালো জাদু করে” ইত্যাদি নানা একাধারে অভদ্র এবং হাস্যকর অভিধায় ভূষিত করা হচ্ছে। প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে প্রতিটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন এবং প্রতিটি সচেতন বাঙালি।

মজার ব্যাপার, এর ঠিক দুই একদিন এর মধ্যেই, রাখি পূর্ণিমা উপলক্ষে, দলমত নির্বিশেষে, বাঙ্গালীর ভোটে নির্বাচিত কয়েকজন বাঙালি জনপ্রতিনিধি বাঙালিকে ইংরেজি এবং হিন্দি অক্ষরে “হ্যাপি রাকশা বান্ধান” জানাতে শুরু করলেন। বলাই বাহুল্য, “হ্যাপি রাকশা বান্ধান” এর স্রোতে গা ভাসালেন বাংলা বিনোদন জগতেরও বহু তথাকথিত তারকা। একজন বাঙালি বেতার ব্যক্তিত্ব তো সামাজিক মাধ্যমে একটা ভিডিওই পোস্ট করে বসলেন, যেখানে তিনি তাঁর শিশু কন্যাকে শেখাচ্ছেন, “বল হ্যাপি রাকসা বান্ধান।”

এটাই আজকে বাঙালির বাস্তব। সেই 1950 এই সংবিধানে হিন্দিকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া থেকে শুরু করে, পরবর্তী কয়েক দশক বলিউড এর পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা, একে একে কেন্দ্রীয় সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গুলোর হেড অফিস বাংলা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, পুঁজি এবং চাকরির নিয়ন্ত্রণ বাঙালির হাত থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি লাগাতার উত্তর ভারতের রাজ্যগুলো থেকে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে আমাদের রাজধানী অবাঙালি দ্বারা পুরোপুরি দখল হয়ে যাওয়া – এই বাস্তব আমাদের জাতির একটা বড় অংশকে গভীর হীনমন্যতার কবলে নিয়ে গেছে। অবশ্যই সাথে ছিল অবাঙালি র প্রতি বাঙালির অতি উদারতা। সব মিলিয়ে আজকের দিনে আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যেখানে বাঙালীর একটা বড় অংশের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। হিন্দি প্রভুর পদলেহন না করলে তাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে তারা মনে করছে।

কিন্তু এরা সেই ভুলটাই করছে, যেটা করতো সেই ভারতীয়রা যারা ব্রিটিশ যুগে ব্রিটিশ প্রভুদের পদলেহন করত সামান্য একটা চাকরির’ আশায়। তারা বুঝতে চায় নী, ব্রিটিশের শত পদলেহন করলেও তারা কোনদিনই ব্রিটিশ হয়ে উঠবে না। তারা বুঝতে চায়নি, ভারতে লাগু ব্রিটিশ আইনের অধীনে একজন ভারতীয় কে হত্যা করা একজন ব্রিটিশের জন্য সবসময়ই না-অপরাধ থাকবে।ঔপনিবেশিক বিশ্বে এটাই আইন।

 

আর আজকের ভারতেও – অহিন্দি জাতি হিন্দিওয়ালা দের পায়ের তলায় থাকবে – অলিখিত (এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিখিত) ভাবে এটাই আইন। বাঙালির ওই আত্মবিস্মৃত অংশ বুঝতে পারছে না যে আগামীকাল তার সন্তান যত ভালো হিন্দিই বলুক না কেন, তার সন্তানের হিন্দি নিয়ে হিন্দি মাতৃভাষার প্রভুরা হাসাহাসিই করবে। তার আমিষ ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের জন্য চিরকাল তাকে অশুচি হিসেবেই দেখবে। আর কোম্পানির ওপরতলার চাকরি গুলো তার নিজের হিন্দিভাষী জাতভাই দের জন্য ই সরিয়ে রাখবে। আর আমাদের বাঙালি ভাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভাঙ্গা ইংরেজি আর প্রায় ঐরকমই হিন্দি শেখা বেচারা ছেলে বা মেয়েটা বড়জোর চাকরের চাকরিটা পাবে।

রিয়া চক্রবর্তীর ঘটনা এখানে বিশেষভাবে শিক্ষামূলক। আপনারা সকলেই জানেন রিয়া সেইরকমই বাঙালি যেরকম ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মান।* অর্থাৎ তিনি এক বর্ণও বাংলা বলতে, পড়তে বা বুঝতে পারেন না; বাংলা বা বাঙালির সাথে তাঁর নামে মাত্র ছাড়া কোনো সম্পর্ক আদৌ নেই। আজীবন ব্যাঙ্গালোরে মানুষ। দক্ষিণী এবং হিন্দি ছবিতে ই অভিনয় করেছেন। আমি অনুমান করছি যে কোন প্রবাসী বাঙালির মতোই রিয়া এবং রিয়ার বাবা-মা আজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন রিয়ার মধ্যে যেন কোন রকম বাঙালি প্রভাব আদৌ না পড়ে সেটা সুনিশ্চিত করতে। আর তাই রিয়া বাঙালির কেউ নয়। রিয়ার কোন কাজের দায়িত্ব বাঙালি জাতির আদৌ নয়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো রিয়ার মূলত হিন্দিভাষী “সর্বভারতীয়” দর্শককূল সেটা বোঝেন না। রিয়া যতদিন শুধুমাত্র একজন উঠতি অভিনেত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন “ভারতীয়”। যেই না তিনি অপরাধে জড়িয়ে পড়লেন, হিন্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিউড দর্শকদের চোখে তিনি হয়ে গেলেন “বাঙালি”। প্রবাসী বাবা মার সারা জীবনের অত একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা বাঙালিত্বের ছোঁয়া বাঁচানোর – সব বৃথা গেল।

আর এজন্যই আমি আপনাকে বলতে চাই – সন্তানকে ভাঙ্গা ইংরেজি হিন্দি শিখতে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পাঠানো, রাখির বাদলে রাকশা বান্ধান, দূর্গা পূজার বদলে নভ্রাত্রি, কালীপুজোর বদলে দিওয়ালি শেখানো বাঙালি অভিভাবক – আপনাদের অবাঙালি “হয়ে ওঠার” প্রচেষ্টা কিন্তু আদতে ফলপ্রসূ হবে না। ঠিক যেমন রিয়ার বাঙালিত্বের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা বাবা-মার আপ্রাণ প্রচেষ্টা বিপদকালে ফলপ্রসূ হয়নি।

এখনো সময় আছে। সাবধান হোন। নিজেকে চিনুন। যদি ভেবে থাকেন হিন্দি প্রভুর আদর্শ দাস হিসেবে নিজেকে তৈরি করাই আপনার টিকে থাকার একমাত্র উপায় তাহলে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন – হিন্দি কে এবং হিন্দিভাষীদের এক কানাকড়ি গুরুত্ব না দেয়া দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলো কেন অর্থনীতি, শিক্ষা, উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোর থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে? কেন ওদের সন্তানরা হিন্দি হয়ে ওঠার কোনরকম প্রচেষ্টা না করলেও তাদের চাকরি পেতে কোন অসুবিধা হয় না?

কেন জানেন? কারণ ওরা ঐক্যবদ্ধ। ওরা জাত্যাভিমানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই আপনাকেও বলি – নিজের জাত্যাভিমান এ একবার বাঙালি হিসেবে, সম্মিলিতভাবে গর্জে উঠতে পারলে আপনার সন্তানের চাকরির সুযোগ গুলো কমবে না, বাড়বে। আপোষ করে কোনোদিনই জেতা যায় না। আপোষ বিজয়ের পথ নয়, পরাজয়ের পথ। ক্রীতদাসত্বের পথ। তাই রাকশা বান্ধান না মানিয়ে, কবিগুরুর প্রচলন করা রাখি পূর্ণিমা উৎসব এর গুরুত্ব আপনার সন্তানকে বোঝান। স্কুলে আরো হিন্দি কেন শেখানো হচ্ছে না সেই দাবিতে নয়, স্কুলে আদৌ হিন্দিতে কথা বলা কেন হচ্ছে সেটা জানতে চেয়ে অভিযোগ পত্র লিখুন। আপনার সাহসিকতা এবং সচেতনতাই একটু একটু করে আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শেখাবে। 

 শ্রীমতী সুলগ্না দাশগুপ্ত
সাধারণ সম্পাদিকা
ঐক্য বাংলা

Facebook Comments Box

সম্পর্কিত পঠিত খবর

সর্বশেষ খবর